যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ইরান ও রাশিয়ার তেল রপ্তানি থেমে নেই।এমনকি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাশিয়ার তেল বাণিজ্যে আয় বৃদ্ধির খবরও এসেছে। আর এই কাজে সহায়তা করছে যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম নিউজিল্যান্ড-ভিত্তিক ছোট বিমা প্রতিষ্ঠান ম্যারিটাইম মিউচুয়াল। এটির মালিকানা আবার এক ব্রিটিশ পরিবারের। কোম্পানিটি এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের মুখে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বা ছায়া বহরের ট্যাংকারগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বিমা পরিষেবা দিয়ে আসছে। এই জাহাজগুলো অবস্থান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয়, জাল নথিপত্র এবং নাম ব্যবহার করে গোপনে তেল বাণিজ্য চালিয়ে যায়।
ম্যারিটাইম মিউচুয়ালের মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ম্যারিটাইম মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন, অকল্যান্ডে একটি কার্যালয় থেকে এটি পরিচালিত হয়। সংস্থাটি গত দুই দশকে ফেরি থেকে শুরু করে পণ্যবাহী জাহাজ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার জাহাজকে বিমা সুবিধা দিয়েছে। তবে রয়টার্সের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এটি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ ছায়া বহরের ট্যাংকারকে এই সুবিধা দিয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে ইরান ও রাশিয়ার তেল পরিবহনকারী জাহাজ।
দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়টার্স উল্লেখ করেছে, গত বড়দিনের সময়, ইয়ুগ (ণঁম) নামে একটি ট্যাংকার চীনের কিংদাও বন্দর থেকে ২ কোটি ব্যারেল ইরানি তেল খালাস করে যাত্রা শুরু করে। একই সময়ে, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল বহনকারী একটি জাহাজ বরফের মধ্য দিয়ে ভারতে যাচ্ছিল। তিনটি ভিন্ন ট্যাংকারের মালিক ভিন্ন হলেও, এগুলোর বিমাকারী ছিল নিউজিল্যান্ডের সংস্থাটি।
এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ)-এর হিসাব অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর থেকে ম্যারিটাইম মিউচুয়ালের কভারেজপ্রাপ্ত জাহাজগুলো কমপক্ষে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলারের ইরানি তেল এবং ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলারের রুশ জ্বালানি পণ্য পরিবহন করেছে। সে হিসাবে মোট বাণিজ্য হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
ম্যারিটাইম মিউচুয়ালের মূল পরিষেবা হলো সুরক্ষা ও ক্ষতিপূরণ (পিঅ্যান্ডআই) বিমা। এই বিমা জাহাজের কোনো দুর্ঘটনা, পরিবেশগত ক্ষতি বা তৃতীয় পক্ষের কারণে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কভার করে।সাবেক মার্কিন ট্রেজারি নিষেধাজ্ঞাবিদ ডেভিড ট্যানেনবাউম-এর মতে, এই বিমা ছাড়া ছায়া বহরের জাহাজগুলো ‘পানিতে নিথর’ হয়ে থাকত, কারণ রাশিয়া বা ইরানের বন্দরেও বিমাবিহীন জাহাজ প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
এই সংস্থাটি পরিচালনা করে ৭৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক পল র্যাঙ্কিন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। কোম্পানির ওয়েবসাইটে তাঁর দুই কন্যা (ক্লেয়ার ও সারাহ) এবং এক জামাতা (স্টিভেন জয়েস) সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই, ২০১৬ সাল থেকে ম্যারিটাইম মিউচুয়াল ইরানি ব্যবসা আকৃষ্ট করার চেষ্টা শুরু করে। তারা ‘নিউজিল্যান্ড পিঅ্যান্ডআই ক্লাব’ নামে একটি সমিতি খোলে। ইরানে নিষেধাজ্ঞার কারণে বিপাকে পড়া গ্রাহকদের নিয়ে এই সমিতি গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে তারা ইরানি শিপিং ফার্ম ‘শিরাজ মেরিন’কে ইরানে এই সমিতির স্বার্থ প্রচার এবং সদস্যদের পরিচিত করার কর্তৃত্ব দেয়।
ইরান ও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর এই কোম্পানির রাজস্বে বিশাল উল্লম্ফন দেখা যায়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে তাদের বিমা বিক্রি গড়ে বছরে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়লেও, ২০১৯ সাল থেকে (ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর) তা গড়ে বছরে ৪১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে গত বছর ১০ কোটি ৮৫ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে রুশ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার প্রথম বছরে এই প্রবৃদ্ধি ৬০ শতাংশে পৌঁছায়।
নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা এবং অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগে নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে বিমা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। রুশ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগের অংশ হিসেবে, গত ১৬ অক্টোবর নিউজিল্যান্ড পুলিশ ম্যারিটাইম মিউচুয়ালের অকল্যান্ড ও ক্রাইস্টচার্চের কার্যালয় এবং অকল্যান্ডের একটি বাসভবনে তল্লাশি চালিয়ে নথি ও রেকর্ড জব্দ করে। পুলিশের আর্থিক অপরাধ বিভাগ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যদিও এখনো কোনো ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।এই তদন্তে নিউজিল্যান্ড সরকার অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
এর মধ্যে ম্যারিটাইম মিউচুয়াল তাদের বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণের ঝুঁকি কমানোর জন্য পুনর্বিমা পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। যেহেতু পুনর্বিমা সংস্থাগুলোও নিষেধাজ্ঞার নিয়ম মানতে বাধ্য,তাই ম্যারিটাইম মিউচুয়াল যদি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে থাকে, তবে তাদের সহযোগী বৈশ্বিক সংস্থাগুলোও ঝুঁকিতে পড়বে।
ম্যারিটাইম মিউচুয়ালের পুনর্বিমা প্রদানকারী প্রধান সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমা বাজার লয়েডস অব লন্ডনের সদস্যরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জার্মানির মিউনিখ রি গ্রুপ (বিশ্বের বৃহত্তম পুনর্বিমা সংস্থা) ; জার্মানির আরেক প্রতিষ্ঠান হ্যানোভার রি; ব্রিটেনের এমএস অ্যামলিন এবং অ্যাট্রিয়াম।
এ ছাড়া, ব্রিটিশ-আমেরিকান বিমা কোম্পানি এওন এবং আমেরিকার লকটনও সংস্থাটির ব্রোকার হিসেবে কাজ করেছে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ম্যারিটাইম মিউচুয়াল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী কোনো কার্যকলাপে জড়িত থাকার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। তারা দাবি করেছে, তাদের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনে ‘শূন্য-সহনশীলতা নীতি’ রয়েছে।
তবে, ২১ অক্টোবর, সংস্থাটি ঘোষণা করে, তারা শিপিং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দ্বারা চিহ্নিত কোনো ‘ছায়া বহরের’ জাহাজ বা রুশ তেল বহনকারী জাহাজের জন্য কভারেজ দেবে না।
ম্যারিটাইম মিউচুয়াল এর আগে জানিয়েছিল, তারা ২০১২ সাল থেকে ৯২টি জাহাজের কভারেজ বাতিল করেছে, কারণ সেগুলোকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।সুত্র-রয়টার্স

ডেইলি খবরের সর্বশেষ নিউজ পেতে Google News অনুসরণ করুন।
আপনার মতামত লিখুন :