বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

ইরানের দানবীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে ইসরায়েল অ্যাকিলিস হিল-দ্য টেলিগ্রাফ

বিশ্ব ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৫, ০১:২৪ পিএম

ইরানের দানবীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে ইসরায়েল অ্যাকিলিস হিল-দ্য টেলিগ্রাফ

আগ্রাসি ইসরায়েল-ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয় যুদ্ধ শেষের ঠিক আগ মুহূর্তে। ইরানের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের মরুভূমি শহর বীর শেবা। সেখানে গত মঙ্গলবার ভোর ৬টার কিছু আগে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। বিস্ফোরণে একটি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একপাশ সম্পূর্ণ উড়ে যায়। পরে ভবনের ভেতরে থাকা ‘নিরাপদ’ ঘরের ভেতরেও বিস্ফোরণ ঘটে।
ঘরে থাকা চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এতে ইসরায়েলিদের মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ জনে। এর আগের দিনই ইরান ঘোষণা করেছিল, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহুমুখী ওয়ারহেডযুক্ত ‘খাইবার শেকান’ (গদর-এইচ) নামের ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। এ ক্ষেপণাস্ত্রকে অনেকে ‘দানব ক্ষেপণাস্ত্র’ বলেও আখ্যা দেন।
যদিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে বীর শেবা হামলায় এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা নিশ্চিত করেনি, তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ এটিকে ‘ইরানের অন্যতম ভারী অস্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হওয়ার পরও ইরান যে এত বড় ধরনের আঘাত হেনেছে, তা স্পষ্ট বার্তা বহন করে। সেটি হলো—ইসরায়েল যদি আবারও শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের সাধারণ নাগরিকরাও মরতে থাকবে। আর উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরও ইসরায়েল এই মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে খুব একটা কিছু করতে পারবে না। আর একেই বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলের ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা দুর্বল জায়গা। মঙ্গলবারের হামলায় চারজনের মৃত্যুর আগের রোববারে পেতাহ তিকভায় একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৪ জন নিহত হন। ওই সময় দুজন সরকারি অনুমোদিত ‘সুরক্ষিত’ আশ্রয় কক্ষে অবস্থান করছিলেন, তবুও প্রাণে রক্ষা পাননি।
যুদ্ধের পক্ষে ইসরায়েলে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও এসব ঘটনা সমাজে গভীর আতঙ্ক আর আত্মবিশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে। কারণ, ইসরায়েলিরা জানে ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধ হবে, এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই নতুন বাস্তবতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তেল আবিবের নিচে বিশাল কংক্রিটের জঙ্গলে গড়ে ওঠা তাঁবু শহরগুলোতে।
৫০ বছরের শালহেভেত ফ্রিডম্যান তাঁর ৭৫ বছর বয়সী মা ক্ল্যারেট এবং ১৭ বছরের মেয়ে ড্যানিয়েলাকে নিয়ে রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তেল আবিবের চেয়ে নিরাপদ স্থান ভেবে পেতাহ তিকভায় ছিলাম। কিন্তু হামলার সময় কাছাকাছিই ছিলাম। বুঝলাম, আসলে কোথাও নিরাপদ নই। বরং এখানে, নিচে আমরা তুলনামূলক নিরাপদ।’
তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তেল আবিবের প্রাণকেন্দ্র ডিজেঙ্গফ সেন্টারের চার তলা নিচে, যা একটি শপিং মলের পার্কিং লট। আলোকসজ্জার নিচে পুরো পার্কিং এলাকাজুড়ে সারি সারি ছোট ছোট রুপালি তাঁবু। যাদের ব্যক্তিগত আশ্রয় কক্ষ নেই কিংবা যাদের আর এসব আশ্রয় কক্ষে ভরসা নেই, তারা গাড়ি চার্জ দেওয়ার জায়গায় নিজেদের ছোট ছোট ঘর বানিয়ে নিয়েছে।‘ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স ইন আর্মস’—নামের সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা, সাবেক সাবমেরিন ক্যাপ্টেন ৬১ বছরের রোনেন কোহলার বলেন, ‘বাইরের দুনিয়া ভাবে তেল আবিবে আধুনিক আশ্রয় কক্ষের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ভবন ৪০,৫০, এমনকি ৬০-এর দশকে নির্মিত। সেগুলো আধুনিক নিরাপত্তা মানদন্ডের আওতায় পড়ে না।’
রোনেন আরও জানান, বয়স্ক নাগরিক ও ছোট শিশুদের নিয়ে যারা থাকেন, তাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ মিনিটের আগাম সতর্কতা যথেষ্ট নয়। এক রাতেই দুই-তিনবার বাচ্চাদের জাগিয়ে নিচে নামতে হয়। পুরো রাত নির্বিঘ্নে ঘুমানোর সুযোগটাই বড় ব্যাপার। তিনি বলেন, এমনকি অনেক তরুণও যাদের নিজস্ব আশ্রয় কক্ষ আছে, তারাও পুরো রাতের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসে। তারা একা মরার ভয় পায়। আশপাশে মানুষ থাকলে কিছুটা সাহস পায়।
এই ব্যবহৃত পার্কিং লটটিই আসলে তেল আবিবের সেই অদৃশ্য চেহারা, যা বাইরের দুনিয়া দেখে না। তেল আবিব সাধারণত আধুনিক, তরুণ-অধ্যুষিত শহর হিসেবে পরিচিত, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যেন অবহেলায় এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ইরানের সঙ্গে চলমান দীর্ঘ সংঘাতের সর্বশেষ রাতের চিত্র আলাদা। ক্লান্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত, নিজের শহরে যেন শরণার্থী হয়ে থাকা নিম্নবিত্ত মানুষের ভিড় এখানে। বড় বড় বাংকারের দরজা খোলা রাখা হয়, যাতে হামলার সময় মানুষ সহজে ভেতরে ঢুকতে পারে।
৪১ বছরের চিকিৎসাকর্মী ওরিত বাইসা কোলে নিয়েছেন তাঁর উদ্ধার করা পিঞ্চার কুকুর স্যান্ডিকে। তিনি জানান, গত এক বছর ধরে নানা প্রশিক্ষকের সাহায্যে কুকুরটির ভয়-আতঙ্ক আর আক্রমণাত্মক আচরণ কমানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে এখন কুকুরটি ‘ভয়াবহ আতঙ্কে’ ভুগছে। সব সময়ই এটিকে ওষুধ খাওয়াতে হচ্ছে।ইসরায়েল সরকারকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে,দেশটির লাখো মানুষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৫৬ শতাংশ বাড়িতে কোনো আশ্রয় কক্ষ নেই। আর ১২ হাজার সরকারি আশ্রয় কক্ষ বেহাল অবস্থায় আছে। বেশির ভাগ ইসরায়েলি হয়তো এ প্রতিবেদনের কথা জানে না, তবে এর বাস্তবতা তারা ভালোভাবেই বুঝে গেছে।
হাইফার বাসিন্দা ২৯ বছরের যান্ত্রিক প্রকৌশলী রিনাত ওয়েইনবার্গ জানান,তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের তথাকথিত ‘নিরাপদ’ ঘরে সঠিক দরজা নেই। কোনো কোনো জায়গায় নিয়মিত কংক্রিটের বদলে শুধু বালি বা পাথরের বস্তা দেওয়া হয়েছে। তিনি কৌতূহলবশত ডিজেঙ্গফের এই পার্কিং আশ্রয়ে নেমে এসেছিলেন, তবে দেখে মনে হচ্ছিল, রাতটা এখানেই কাটাবেন।
রিনাত বলেন,‘হাইফায় আমরা শেষ পর্যন্ত ট্রেন চলার সময়ও পাতাল রেল স্টেশনে রাত কাটিয়েছি। একেবারে পাগলাটে অবস্থা। আমরা যেন এখন ঘরছাড়া যাযাবর।’এর আগে, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েল আইন করে,নতুন সব বাসাবাড়িতে সুরক্ষিত ঘর রাখতে হবে। বর্তমানে দেশটির বাড়িগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ের ৩ ধরনের হয়ে থাকে মামাদ বা ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে থাকা সুরক্ষিত ঘর, মামাক বা প্রতিটি ফ্লোরে কমিউনাল নিরাপদ ঘর এবং মিকলাট বা সরকারি আশ্রয় কক্ষ।
তবে এসব ব্যক্তিগত আশ্রয় সুবিধাও মূলত ধনী শ্রেণির নাগালেএমনটাই বলা হয়েছে সেই সরকারি প্রতিবেদনে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ পাওয়া গেছে তেল আবিবের কম আয়ের দক্ষিণাঞ্চলের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের কাছে গুমোট, অন্ধকার,দুর্গন্ধযুক্ত কংক্রিটের গহ্বরে গড়ে ওঠা আরেকটি তাঁবু শহরে।
সেখানে ১১ মাসের শিশু কাইলকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন ফিলিপাইনের গৃহকর্মী লিন তাগাকাই। তিনি বলেন,‘আমাদের আশপাশে কোনো বোমা আশ্রয় কক্ষ ছিল না। আমি দৌড়ে সেখানে যেতে পারতাম না। খুব ভয় লাগত। তাই নিচে চলে আসাটাই সহজ মনে হয়েছে।’ এখন যখন ক্ষেপণাস্ত্রের ধুলো ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে, তখন ইসরায়েলে শুরু হয়েছে নতুন প্রশ্ন—কিভাবে সাধারণ মানুষকে আরও ভালোভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়?
যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিজয় ঘোষণা করেছেন, এখনো পরিষ্কার নয় ইরান পারমাণবিক অস্ত্রে কতটা সক্ষম। ফলে ইসরায়েল নতুন করে হামলা চালালে ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিশ্চিত নয়। তবে এটা জানা গেছে, ইরানের কাছে এখনো শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত আছে। আর ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নতই হোক, তা শতভাগ কার্যকর নয়। এ কারণে তেল আবিবের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা কয়েক শ মানুষ আর পুরো দেশের প্রায়য় ১০ হাজার উদ্বাস্তু জানে এই পরিস্থিতি আবারও ফিরে আসতে পারে, খুব বেশি সময় নাও লাগতে পারে এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা মোটেও নিরাপদ নয়।
 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!