রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

চেয়ারম্যানরা এমপির দৌড়ে ফেল করে আবার উপজেলা নির্বাচনে

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৪, ০৪:৫২ পিএম

চেয়ারম্যানরা এমপির দৌড়ে ফেল করে আবার উপজেলা নির্বাচনে


স্বপ্ন ছিলো এমপি হওয়ার। তাই উপজেলা থেকে পদত্যাগও করেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়ায় আবার ফিরতে চান উপজেলায়। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৫০ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছিলেন। তবে নির্বাচিত হয়েছেন এক-তৃতীয়াংশের কম। হেরে যাওয়া চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ আবার উপজেলা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানুষ বলছে গণতন্ত্রেও মোড়কে এটা ফায়দাতন্ত্র।
এমপি হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছিলেন সে স্বপ্ন ফিকে হওয়ায় আবার স্বপ্ন নিয়ে ফিরছেন উপজেলা নির্বাচনে। যাদেও ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। এখন আবার ফিরতে চাইছেন উপজেলায়। ফলে সংসদ নির্বাচনের মাত্র চার মাসের মাথায় হতে যাওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে লড়বেন পদত্যাগ করা সেই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের কয়েকজন।
স্থানীয় নির্বাচনী আইন অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিভিন্ন উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যানরা পদত্যাগ করেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের হিসাব অনুযায়ী,অর্ধশত চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছিলেন।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচনে বিকল্প প্রার্থী রাখার কথা বলায় এবং বিএনপিবিহীন নির্বাচনে সহজে জয়ের আশায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা পদত্যাগ করেন।তবে পদত্যাগকারী চেয়ারম্যানদের অধিকাংশই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। ৫০ জনের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের কম নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক সুত্রগুলো জানায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাসের মাথায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদে এবার নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি ও দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে।
খোজ নিযে জানাগেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়া চেয়ারম্যানদের অন্তত সাতজন আবারও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলেও জানাগেছে।আর বাকি পদত্যাগকারী চেয়ারম্যানরা এখনো নির্বাচন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাননি। তাঁদের উপজেলায় নির্বাচন হবে তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করা বেশির ভাগই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে লড়াই হয় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের। জাতীয় নির্বাচনের রেশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী করছেন আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সদস্য ও নিজের অনুগতদের। ফলে পদত্যাগকারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যাঁরা আবার নির্বাচনে অংশ নেবেন, তাঁদের লড়াই হবে সংসদ সদস্যের অনুসারীদের সঙ্গেই।
সুত্র জানায় দলে পদপদবির জন্য এখন প্রবল প্রতিযোগিতা। সংসদ সদস্য তো এখন সোনার হরিণ। সেটা হতে না পারলে ভালো বিকল্প উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া। ক্ষমতার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা, বিভিন্ন রকম অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ থাকাতেই পদত্যাগকারীরা আবার ফিরতে চাইছেন।
দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যানদের জন্য আবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করা সহজ হবে না। জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধি¦ নতুন সংসদ সদস্যের সমর্থন না পাওয়া, আগেরবারের মতো এবার নৌকা প্রতীক না থাকা এবং জাতীয় ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাঝে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকায় পদত্যাগকারী চেয়ারম্যানদের পুরোনো পদে ফেরা চ্যালেঞ্জিং হবে।
জানাগেছে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের দুবারের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন। চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে মোখছেদুল হেরে যান জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী সিদ্দিকুল আলমের কাছে। নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছিল জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত এইচ এম এরশাদের ভাগনে আহসান আদেলুর রহমানকে। সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিন বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ আমার জন্য অনুকূল ছিল না। তবে ভোটারদের অভূতপূর্ব সহানুভূতি পেয়েছি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার ও সমর্থকেরা আমাকে চান। মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা অসম্ভব।’
খুলনার ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন। তিনি ওই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) প্রতিদ্বন্ধি¦তা করতে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শেখ আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে যেহেতু সংসদ নির্বাচন করলাম, মাঠ সব গুছানো আছে। উপজেলা নির্বাচনের জন্য সবাইকে ডেকেছিলাম। সবাই অনুরোধ করল নির্বাচন করার জন্য। আমিও তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি।উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার ও সমর্থকেরা আমাকে চান। মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা অসম্ভব।
মোখছেদুল মোমিন, সৈয়দপুর উপজেলার পদত্যাগী চেয়ারম্যান, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাবির মিয়া পদ ছেড়ে গোপালগঞ্জ-১ (মুকসুদপুর-কাশিয়ানী) আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধি¦তা করবেন।  দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন মোহাদ্দেস হোসেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধি¦তা করতে তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বেনজীর আহমদ বিজয়ী হন।
মোহাদ্দেস হোসেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, ‘কীভাবে নির্বাচনটি করা যায়, আপাতত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঈদের পর থেকে প্রচারণা শুরু করব।’ এদিকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই আকন্দ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নও পান। কিন্তু জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতায় আসনটি জাপাকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেও সংসদ নির্বাচনে অংশ নেননি আবদুল হাই। তিনি আবারও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) প্রতিদ্বন্ধি¦তা করতে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শেখ আকরাম হোসেন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে সংসদ সদস্য প্রার্থী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাইনুদ্দিন। প্রায় ৪৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে যান। এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান মাইনুদ্দিন। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে তিনি সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।গাজী মাইনুদ্দিন বলেন,‘আমি আমার দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বসছি। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। আমি মনে করি, দলের নেতা-কর্মীদের সিদ্ধান্তই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বিএনপিবিহীন জাতীয় নির্বাচনে সহজে জয়ের আশায় উপজেলা চেয়ারম্যানেরা পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই হেরেছেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের কাছে। এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকছে না। ফলে পদত্যাগ করা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এটিকে নিজেদের জন্য সুযোগ হিসেবে দেখছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন দেশের ‘ফায়দাতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক চর্চার কারণেই পদত্যাগকারী চেয়ারম্যানরা আবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
দলে পদপদবির প্রবল প্রতিযোগিতা থাকায় রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা হাতছাড়া করতে চাননা অনেকেই। সংসদ সদস্য তো এখন সোনার হরিণ। সেটা হতে না পারলে ভালো বিকল্প উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া। ক্ষমতার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা, বিভিন্ন রকম অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ থাকাতেই পদত্যাগকারীরা আবার ফিরতে চাইছেন। দলীয় সুত্রগুলো জানায় আসন্ন উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলে প্রার্থীদেও বিজয় পাওয়া সহজ হবে না। ব্যক্তি ইমেজ সবার সমান না। স্বতন্ত্র এমপিরা তাদের পাওয়া সুযোগও হাত ছাড়া করবেননা। ফায়দাতন্ত্র এবার সহজ হবার নয়।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!