মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির মোকাবিলা করা কী কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব? সেলিম খান

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম

মোদির মোকাবিলা করা কী কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব? সেলিম খান


ভারত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হয়েছে তা-ও প্রায় ৭৭ বছর হতে চলল। এই দীর্ঘ সময়ে দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল কংগ্রেস কখনো টানা ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকেনি। এই প্রথম ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে দলটি। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে আর তারা ক্ষমতার ধারে–কাছে ঘেঁষতে পারেনি। ২০২৪-এও পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহদের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসক এবং বিজেপি ও এর মাতৃতুল্য সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) মতো সংগঠিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন, তা বর্তমান কংগ্রেস নেতৃত্ব দেখাতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। এর সাথে বিজেপি বা আরএসএস ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণে যে সূক্ষè (কখনোকখনো মোটা দাগে) সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলা শুরু করেছে, তা কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে সেটাও কংগ্রেসের নেতৃত্বের কাছ থেকে জানা সম্ভব হয়নি। শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ¯েøাগান তুলে এর মোকাবিলা কঠিন, এটা এতদিনে প্রমাণিত। তবে এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন বলে মনে হয় না যে, ভারতে বিজেপির পাল্টা শক্তি দাঁড় করাতে হলে কংগ্রেসেরও কোনো বিকল্প নেই।
কংগ্রেস ১৩৯ বছরের একটা পুরোনো দল। জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৬ বার ভেঙেছে। তারপরও কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর, অরুণাচল থেকে গোয়া–সর্বত্রই কংগ্রেসের একটি হলেও দলীয় কার্যালয় আছে। একজন হলেও কংগ্রেসের নেতা-কর্মী-সমর্থক আছে। যা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও বিজেপির নেই। এই বিপুল বিস্তৃতি যেমন কংগ্রেসের জন্য ইতিবাচক, তেমনি নেতিবাচকও বটে। এই বিশাল বপুকে ঠিক মতো চালানোর জন্য মস্তিষ্কের যে আকার ও কার্যকারিতা থাকা প্রয়োজন, তা দলটির নেই। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে কিনা, এ সন্দেহ জাগাটা অসমীচীন হবে না। বিশেষত গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে চলার কারণে দলটির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।
কংগ্রেসের আরেকটি বড় সমস্যা ভিন্ন মত মেনে নেওয়ার অক্ষমতা। এই যে ৬৬ বার ভেঙেছে, তার অধিকাংশ এই কারণে। ১৯২৩ সালে জওহরলাল নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যে স্বরাজ পার্টি করেছিলেন, তার কারণ ছিল ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কী হবে–এ নিয়ে বিতর্ক। ১৯৩৯ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর সাথে মতবিরোধের কারণে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের মূল কারণই ছিল কংগ্রেসে তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানেরা (যার নেতৃত্বে অধিকাংশই ছিলেন জমিদার ও নবাবরা, একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলা) নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাননি। ১৯৪৭-এর দেশভাগ এড়াতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে ক্ষমতার যথাযথ ভাগ দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেসের একপক্ষের সমর্থন ছিল। কিন্তু দলের ক্ষমতাসীনেরা ছিলেন অনড়। যার ফলে কোনো সমঝোতা হয়নি। এই সাতকাহন গাওয়ার একটাই কারণ যে, কংগ্রেস সেই ট্র্যাডিশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
গত বছরের ২৩ জুলাই বিহারের রাজধানী পাটনায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যেটি ছিল বিজেপির জন্য প্রথম ধাক্কা। কিন্তু এই জোটকেও ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেনি কংগ্রেস। জোটের বড় উদ্যোক্তা নীতীশ কুমার পল্টি খেয়ে বিজেপির কাছে ফিরে গেছেন। এর মধ্যে চার রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে। যার দুটিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু শরিকদের উপযুক্ত মর্যাদা না দেওয়া এবং নিজের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে রাজস্থান ও ছত্তিশগড় হারায় কংগ্রেস। তারপরেও কংগ্রেস নেতৃত্ব শিক্ষা নেননি। তাঁরা জানতেন, এত বড় জোট টিকিয়ে রেখে লোকসভায় বিজেপির মুখোমুখি হতে গেলে প্রথম দরকার ছিল দ্রæত আসন রফা। এবং এতে বড় দল হিসেবে কংগ্রেসের ছাড় দেওয়া। নিঃসন্দেহে এটা খুবই কঠিন কাজ। তা জানা সত্ত্বেও কোনোটাই তারা করেনি। ফলে রাজ্যে রাজ্যে যে সম্মিলিত আওয়াজ ওঠার দরকার ছিল, তা হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। এমনকি জোটের দুইজন মুখ্যমন্ত্রী (অবরিন্দ কেজরিওয়াল ও হেমন্ত সোরেন) গ্রেপ্তার হওয়ার পর যে প্রতিবাদ হওয়ার দরকার ছিল, তা কিন্তু ইন্ডিয়া জোট পারেনি। এমনকি জোটকে এই অবস্থায় রেখে তাঁরা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না যে, বিজেপি ২৭২ আসনের কম পেলে জোটের কোনো দল গিয়ে আবার তাদের সাথে যোগ দেবে না। ফলে কংগ্রেসের সামনে চ্যালেঞ্জ বহুবিধ।
এরপরেও সুবিধা আছে দলটির। ভারতে একাধিক দল আছে যারা কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস, মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ারের এনসিপি, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানার বিআরএস, জম্মু ও কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির পিডিপি। এর বাইরেও অসংখ্য ছোট দল আছে, যারা শুধু ব্যক্তিদ্বন্দ্বের কারণে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কংগ্রেস নেতৃত্ব এই ছিন্ন হওয়া সাবেক সহকর্মীদের একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আনতে পারে, যেখানে তাঁদের স্বাধীন সত্তা যেমন বজায় থাকবে তেমনি মর্যাদায় খামতি হবে না। ‘মুই কী হনু রে’ এই অস্মিতা ত্যাগ করে তাঁদের এগোতে হবে।
স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি একাধিকবার ক্ষমতায় আসার পরও, কখনোই তারা কেউই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি। অর্থাৎ ভারতের সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়েই সে দেশের শাসকেরা গদিনশিন হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর আবেগে ভেসে গিয়েছিল গোটা ভারত। ইন্দিরা-পুত্র রাজীব গান্ধী পুরোপুরি এর সুযোগ নেন। এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে ৪০৪, পরে আরও ১০টি আসনে জিতে ৪১৪ আসনে মালিক হন। তখন ৫৪৩ আসনের লোকসভায় ৭৬ শতাংশ আসনের অধিকারী ছিল কংগ্রেস।
এক্ষেত্রে ইতিহাসও তাঁদের পক্ষে। স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি একাধিকবার ক্ষমতায় আসার পরও, কখনোই তারা কেউই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি। অর্থাৎ ভারতের সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়েই সে দেশের শাসকেরা গদিনশিন হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর আবেগে ভেসে গিয়েছিল গোটা ভারত। ইন্দিরা-পুত্র রাজীব গান্ধী পুরোপুরি এর সুযোগ নেন। এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে ৪০৪, পরে আরও ১০টি আসনে জিতে ৪১৪ আসনে মালিক হন। তখন ৫৪৩ আসনের লোকসভায় ৭৬ শতাংশ আসনের অধিকারী ছিল কংগ্রেস। অথচ ওই জোয়ারেও তারা ভোট পেয়েছিল ৪৬.৮৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে মোদির দল সর্বোচ্চ ৩০৩টি আসন পেলেও ভোট পেয়েছিল মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ। এটা থেকে স্পষ্ট ভারতে শাসকের বিরোধীরা ছত্রখান হয়ে থাকায় খুব সহজেই জয়ের দেখা পেয়েছে তারা। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ভারতে শাসকেরা গত ৭৭ বছর ধরে ক্ষমতায় এসেছে।
তবে বিরোধীরা এক হলে যে শাসকের ঘটি উল্টাতে পারে তার বড় প্রমাণ ১৯৭৭ ও ১৯৮৯। দুইবারই কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল বিরোধীরা এক হওয়ার কারণে। এই বিষয়টি কংগ্রেস বোঝে কিনা জানি না, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি-আমিত শাহরা খুব ভালো বোঝেন। সে কারণে ইন্ডিয়া জোট গঠনের পর থেকে বিজেপি তা ভাঙার চেষ্টায় ব্যস্ত। জোটের অন্যতম কারিগর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে টেনে সে প্রমাণ দিয়েছে। যাদের পারেনি তাদের পেছনে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট) লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। জালে আটকে ফেলা হয়েছে কেজরিওয়াল, হেমন্থ সোরেনসহ একাধিক নেতাকে। কংগ্রেসের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। উল্টে ১৮০০ কোটি টাকা কর দাবি করা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি পানির মতোই স্বচ্ছ। মোদি নির্বাচনে জিততে দলের নেতা-কর্মীদের চেয়ে রাষ্ট্রীয় দমনযন্ত্রের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, এ অভিযোগ সর্বত্র। এ থেকে বাঁচার একটাই উপায় নিজেদের একজোট হওয়া, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করা।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ন্যায়পত্র নামের ওই ইশতেহারে তিন ডব্লিউর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ক (কাজ), ওয়েলথ (সম্পদ) ও ওয়েলফেয়ার (কল্যাণ) সবই ভারতের সাধারণ নাগরিকদের জন্য। নারী ভোটারদের আকর্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় চাকরি ৫০ শতাংশ তাদের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জাতভিত্তিক জনগণনার প্রতিশ্রæতি রয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বে কমিটি দলের জন্য ন্যায়ভিত্তিক সমাজের একটা প্রতিশ্রæতি ভোটারদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ইশতেহারে জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিলেও রদ হওয়া ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদা নিয়ে টু শব্দটি করা হয়নি। লাদাখ আলাদা থাকবে না কাশ্মীরের সাথে ফিরে যাবে, তা নিয়েও কথা নেই। এখানেই মোদি বা বিজেপির সাফল্য। তাঁরা ভবিষ্যৎ ভারতের যে রূপরেখা তৈরির দিকে এগিয়ে চলেছেন, কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলকে সেটাই মানতে হচ্ছে। ফলে শুধু কর্মসংস্থান, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য, দৈনিক ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়ার মাধ্যমে কী ভোটারদের মনোরঞ্জনের সম্ভব? যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় পরিচয়ের আবেগ ভোটারদের একটা বড় অংশের মগজধোলাই করে ফেলেছে, সেখানে ‘ন্যায়পত্র’ নামের ‘যন্তরমন্তর’ কতদূর কাজে দেবে বলা দুষ্কর।
২০১৯ সালে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস যেভাবে লড়াই শুরু করেছিল, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন কিছু একটা বোধহয় হবে। শেষ পর্যন্ত ৫২টি আসন নিয়ে কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। মোট আসনের ১০ শতাংশ না পাওয়ায় বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি তারা। ফলে লড়াইটা যে খুব সহজ না এটা বোঝার মতো পরিপক্বতা কংগ্রেসের নেতৃত্বের থাকতে হবে। যেখানে ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির ঘোষিত নীতিই হলো ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!