আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য আমার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা একটু দেরিতেই শুরু হয়, এর আগে আম্মার কাছেই পড়ালেখা করতাম। আমাদের বাসায় একটা নিয়ম ছিল, লেখাপড়া শুরুর আগে হাতেখড়ি নামের এক ঘরোয়া আনুষ্ঠান হত। মসজিদের ইমাম সাহেব আসলেন, আমি পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে টুপি মাথায় দিয়ে বসলাম, সামনে আমপারা দেওয়া হল, ইমাম সাহেব আমাকে আলিফ, বা, তা ইত্যাদি পড়ালেন, হয়ে গেল আমার হাতেখড়ি, সবাই মিলে মিষ্টি খেলাম। হাতেখড়ি অর্থ কি আমি এখনো জানি না, তবে নিয়ম ছিল হাতেখড়ির আগে কোন প্রকার পড়াশোনা করা যবে না। হাতেখড়ির পর আমি নিয়মিত মসজিদে যেতাম আরবি পড়ার জন্য আর বাসায় আম্মার কাছে অন্যান্য পড়া পড়তাম। মসজিদে সবাই লাইন ধরে দুলে দুলে আরবি পড়ছে, সবাই এক জিনিস না, কেউ আলিফ,বা, তা, মুখস্থ করছে কেউ সুরা মুখস্থ করছে, কেউ আবার কোরআন শরিফ পড়ছে, কিন্তু একই হুজুর সবাইকে ঘুরে ঘুরে পড়াচ্ছেন। আরবি পড়ার খুব একটা ইচ্ছা আমার থাকতো না, তাই মাঝে মাঝে বিভিন্ন অজুহাতে কামাই দিতাম বা আগে চলে আসতাম, তবে যেদিন কোন কারণে জিলাপি দেওয়া হতো, সেদিন অনেকক্ষণ থাকতাম।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হল, রায়ের বাজার হাই স্কুল। স্কুলের একদিকে টিনের ছাদের বেড়া দেওয়া ঘর, প্রাইমারির ছাত্রদের ওখানে ক্লাস হয়, অন্যদিকে টিনের ছাদ দেওয়া পাকা ইটের ঘরে ক্লাস হয় হাইস্কুলের ছাত্রদের, মাঝে বিশাল মাঠ। সকালে সাতটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত মেয়েদের ক্লাস হয়, আর এগারোটা থেকে বিকাল পাচটা পর্যন্ত ছেলেদের ক্লাস হয়। মাঝে ছিল একঘন্টার বিরতি, ২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত। ছেলেদের সাড়ে দশটার আগে স্কুলে আসা নিষেধ, যাতে মুখ দেখাদেখি না হয়। আমার স্কুল শুরু হয় চতুর্থ শ্রেণী থেকে, আর এখনকার বাচ্চারা চার বছর স্কুলে পড়ার পর ক্লাস ওয়ানে উঠে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকতে কেমন যেন ইতস্তত করছিলাম, মনে হচ্ছিল সবাই যেন আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে, গিয়ে বসলাম একেবারে পিছনের দিকের এক বেঞ্চে। সবাই সবার সাথে কথাবার্তা বলছে, কেউ আমার সাথে কোন কথা বলছে না। আমার ডানের জন তার ডানদিকের ছেলের সাথে কথা বলছে আর বায়ের জন তার বাদিকের ছেলের সাথে কথা বলছে, আমি চুপচাপ বসে আছি। এইভাবে তিন চারদিন কেটে গেল, একদিন সাহস করে গিয়ে বসলাম একেবারে ফাস্ট বেঞ্চে। শ্যামলা ধরনের, চোখে চশমা পড়া এক ছেলের পাশে, হাসলে তার গালে টোল পড়ে, তার পাশে ছিল লম্বা মতন এক ছেলে। তারা সেধেই আমার সাথে কথাবার্তা বললো, আমার খুব ভাল লাগলো। চশমাটার নাম মনিরুল ইসলাম রিপন আর লম্বাটার নাম বোরহান কবির, এদের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব, সব সময় একসাথেই বসে, অবসরে একসাথে গলা জরিয়ে মাঠে ঘুরাঘুরি করে, একেবারে বর্তমান যুগের ধানমন্ডি লেকের ছেলেমেয়েদের মতোই, এরা দুজনেই খুব ভাল ছাত্র, স্কুলে প্রথম দিকে থাকে, এদের মতো বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচয় হতে লাগলো, পিছনের বেঞ্চের ছাত্রদের থেকে সামনের বেঞ্চের ছাত্ররা একটু বেশি ভালো, তাই ওখানেই বসতাম। ওখানে আরো ছিল পাতলা ছিপছিপে গরণের অনেক ফর্সা একজন, নাম শাহাদাৎ হোসেন দিলু, এবং একটু দুস্ট টাইপের, দ্রæত কথা বলে একজন নাম আবু সাইদ। আবু সাইদ নামের অর্থ নাকি সন্মানের পিতা, ও দুস্টামি করে আমাদের বলতো তোরা আমাকে সন্মান করবি। সবাই খুব ভাল ছাত্র, ক্লাসে ফাস্ট সেকেন্ড হয়।
স্কুলে বেতের ব্যবহারটা একটু বেশি ছিল, বেতের ভয়েই পড়ালেখা করতাম। স্কুলে বিএম স্যার বলে একজন শিক্ষক ছিলেন, উনি আমাদের ইতিহাস ভূগোল পড়াতেন, উনি বেতের ব্যবহারটা একটু বেশি করতেন, সবসময় বাম হাত ব্যবহার করতেন । বিএম নামের অর্থ আমরা জানতাম না, আবু সাইদ বলত স্যার বাম হাতে মারে তাই নাকি বিএম। বিএম স্যারের ভাইও আমাদের শিক্ষক ছিলেন, ওয়াহিদ উদ্দিন স্যার, উনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, ওনাদের ছেলেরাও আমাদের সাথে পড়তো, কচি আর কাজল। ওয়াহিদ উদ্দিন স্যারের একটা লাইব্রেরী ছিল, বই খাতা পাওয়া যেত, ওনাকে একা পেলেই খুশি করার জন্য বলতাম,স্যার আজকে আপনার লাইব্রেরিতে যাবো, খাতা কলম কিনতে হবে।
একদিন হটাৎ দেখি স্কুলের ভিতর একটা বড় গাড়ি ঢুকলো, পাচ-ছয়জন মানুষ অ্যাপ্রোন পড়ে সোজা হেড স্যারের রুমে গেলেন, এদের মধ্যে একজন মেয়েও ছিল। কিছুক্ষণ পর হেড স্যার সহ সবাই মিলে ঢুকলেন প্রথম শ্রেণির ক্লাস রুমে। কিছুক্ষণ পর ওই রুম থেকে চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। আমাদের ক্লাসের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল, সবাই উদ্বিগ্ন, কি হচ্ছে ওখানে, স্যার বললেন কলেরার ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে, আস্তে আস্তে সব ক্লাসেই আসবে। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল, চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। সত্যিই তাই, একের পর এক সব ক্লাসেই ঢুকছে, যেখানেই ঢুকছে সেখান থেকেই কান্নাকাটির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার দরজা দিয়ে বেড়িয়ে দৌড় দিচ্ছিল, মাঠে দন্ডায়মান দুই দফতরি মাখন দা এবং চিত্র দা তাদের ধরে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। আমি আবু সাইদকে জিজ্ঞেস করলাম, কি করা যায়? ও` দুষ্টামির হাসি দিয়ে বলল, কি আর করবি, ঝুড়ির মুরগিকে যখন একে একে জবাই করে তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না, আমরাও একটু পরেই জবাই হব, আমার বুকের ভিতর কেমন যেন চিনচিন করে উঠলো। আমাদের ক্লাসে তখন ইসলামিয়াতের স্যার ছিলেন, উনি একটু বৃদ্ধ বয়সী ছিলেন, আবু সাইদ স্যারকে জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনাকেও কি ইঞ্জেকশন দিবে? স্যার বললেন, না-রে পাগল, আমাকে দিবে কেন, আমিতো বুড়া মানুষ, ইঞ্জেকশনতো তোদের মতন বাচ্চাদের। আবু সাইদ দুষ্টামি করে বললো, না স্যার, স্যারদের কেও দিচ্ছে দেখলাম। স্যারের মুখ ম্লান হয়ে গেল, মুখ থেকে হাসি চলে গেল, স্যারকে কেমন যেন বিচলিত দেখাতে লাগলো। এরপর ছয়-সাতজন একসাথে হুড়মুড় করে আমাদের রুমে ঢুকলো, আমি ভয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলাম, বইখাতা রেখে রুমের পিছনের বেড়া ভেঙে দিলাম এক দৌড়। দৌড় আর থামে না, একেবারে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় এসে হাজির। বাসায় এসে বললাম, স্কুলে মারামারি লেগেছে তাই বইখাতা রেখে চলে এসেছি। পরের দিন যথারীতি স্কুলে গেলাম, গিয়ে দেখি টিচার ক্লাসে চলে এসেছেন, রোল কল হচ্ছে, অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। টিচারের টেবিলের উপর আমার বইখাতা, পাশে একটা মোটা বেত, বুঝতে বাকী রইলো না আমার কপালে কি আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, চিন্তা করলাম কালকে পালানো ঠিক হয় নি, কি`বা হতো ইঞ্জেকশন দিলে, একটু না-হয় ব্যাথাই পেতাম, মরে তো যেতাম না, সবাই তো ভালোই আছে, কেমন হাসছে। এখনতো সবার সামনেই আমাকে বেত্রাঘাত করা হবে, কি লজ্জার ব্যাপার, লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হল। আবু সাইদকে জিজ্ঞেস করলাম কি হবে আমার, ও`বললো, গত বছর একজন ইঞ্জেকশন দেয়নি, তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। রোল কল শেষে স্যার আমাকে ডাক দিলেন, সবাই হোহো করে হেসে উঠলো, আমি ভয়ে কাপতে কাপতে স্যারের সামনে দাড়ালাম, স্যার বললেন, কি-রে পাগল, কাল দৌড় দিছিলি কেন, ইঞ্জেকশনতো তোদের ভালোর জন্যই দেওয়া হয়। আর কোনদিন এমন কাজ করবি না, যা তোর বইখাতা নিয়ে যা। খুশিতে আমার চোখে অশ্রæ চলে এলো, স্যারকে আমার ফেরেস্তা মনে হতে লাগলো, এতবড় অপরাধ করলাম, স্যার আমাকে কোন শাস্তিই দিলেন না।
একবার রিপন আর বোরহানের মধ্যে কি নিয়ে যেন ঝগড়া হলো, দুজন আংগুলে আংগুল লাগিয়ে আড়ি নিয়ে নিল, কেউ কারো সাথে কথা বলে না, এমনকি পাশেও বসে না। এনিয়ে স্কুলের সবাই খুব আনন্দ উপভোগ করতে লাগলো, একজনের খাতা অন্য জনের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আবার একজনকে কিছু দিয়ে তা অন্যজনকে দিতে বলা হয়, কিন্তু এতেও কোন কাজ হচ্ছে না, দু`জনই অটল, কেউ কারো সাথে কথা বলবে না। ব্যাপারটা শিক্ষককে জানান হলো, উনি অনেক বোঝালেন কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। শেষমেশ স্যার বললেন, হয় তোমরা কথা বল না হয় কান ধরে দু`জনই দাড়িয়ে থাকো। দুজনেই সাটাং হয়ে কান ধরে দাড়িয়ে গেল। এইভাবে কিছুদিন চললো, তারপর আবার তাদের মধ্য গলায় গলায় ভাব হলো।
একবার বছরের শুরুতে স্কুলে স্পোর্টস এর আয়োজন চলছে, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি, আমার খুব সখ খেলায় নাম দেওয়া। দৌড়, হাইজ্যাম্প লং জ্যাম্প ইত্যাদি সব কিছুতেই নাম দিলাম। বাছাই পর্বে একে একে সবকটাতেই বাদ পরলাম। আমাদের স্কুলে ক্লাস অনুসারে গ্রুপ হত না, উচ্চতা অনুসারে হত। আমি ছিলাম অনেক লম্বা, তাই আমাকে নাইন-টেনের বড়ভাইদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হতো, যা ` আমার পক্ষে ছিল একেবারেই অসম্ভব। আমার মতো বাদ পরারা মিলে ঠিক করলাম স্পোর্টসে আমরা অংশগ্রহণ করবোই, এমন একটা আইটেমে অংশগ্রহণ করতে হবে যেখানে বাছাই হয় না। স্পোর্টসের দিন সকালে আমি লুংগি পড়ে, মাথায় গামছা প্যাচিয়ে, মুখে হালকা দাড়ি মোচ লাগিয়ে মাথায় ডিব্বাডুব্বা নিয়ে মাঠে প্রবেশ করলাম, ঝালমুড়ি ওয়ালা সাজলাম। যেমন খুশি তেমন সাজোতে বাছাই এর বালাই নাই, সেজেগুজে মাঠে ঢুকলেই হলো। ভালোই ব্যবসা হতে লাগলো। মাঠে আরো ছিল জংলী মানুষ, ঝাড়ুদারনি, ডাক পিয়ন, মাটির মুর্তি এবং মালিনী। যে যার মতন ঢং ঢাং করছে আর আমি ব্যবসা করে যাচ্ছি। স্কুলের মাঠে ফেরিওয়ালা প্রবেশ নিষেধ, তাই আমার ব্যবসা তুঙ্গে। জংলী মানুষটি খুবই ঝামেলা করছে, একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ওর ব্যাগ টান দিচ্ছে ইত্যাদি। জংলী মানুষটি আমার সামনে এসে হাজির, আমি এক ঠোংগা ঝালমুড়ি দিয়ে বললাম, আমারে আর জালাইস না, সে মুড়ি নিয়ে চলে গেল।
মাঠের সবারই দৃষ্টি অপরুপা সুন্দরী মালিনীর দিকে। সে নিজেকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে, খোপায় ফুল, গলায় ফুল, হাতে ফুল, ঝুড়ি ভরা ফুল, আসলেই তাকে অপরুপা সুন্দরী লাগছে। নাইন-টেনের বড়ভাইরা কি কি যেন বলছে, ইয়াং স্যারেরাও আড়চোখে তাকাচ্ছে।
স্পোর্টস শেষে পুরস্কার দেওয়ার পালা, যেমন খুশি তেমন সাজোদের মাঠের এককোণে লাইন দিয়ে বসতে বলা হল, আমি ডাব্বাডুব্বি রেখে এককোনায় গিয়ে বসলাম, পাশেই দেখি জংলী মানুষ আমি ভয়ে অন্যপাশে চলে গেলাম। ওইপাশে গিয়ে দেখি আমার পাশে মালিনী, আমি লজ্জায় একটু সরে বসলাম। আমি যতই সরি ও` আমার গা`ঘেষে বসে, আমি লজ্জায় একটু দূরে যাই ও`আমার কাছে আসে। ও`আমার পাশে এসে বলে, " তুই এমন করছিস কেন? " আমি বললাম, আমার লজ্জা লাগে, আমি কোন মেয়ের পাশে এইভাবে বসি না, ও`বলে কে মেয়ে, আমি বললাম, কেন আপনি, মালিনী বলে পাগল, আমিতো সাবির। আমি বলি কোন সাবির, ও, বিরক্ত হয়ে বলে তোদের ক্লাসের সাবির। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তুই মেয়ে হলি কবে? আসলে ও`কে একেবারেই মেয়ের মতোই লাগছিলো। সাবির আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলে, চেহারার মধ্যে একটা মেয়েলি ভাব আছে, ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা ওর পাশে বসার জন্য প্রতিযোগিতা করতো।
সবশেষে যেমন খুশি তেমন সাজোর বিজয়ীদের নাম ডাকা হচ্ছে, আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি।প্রথমেই ডাক পরলো ঝাড়ুদারনির, ও তৃতীয় হয়েছে, তারপর ডাকলো মাটির মুর্তির, আমার টেনশন আরো বেড়ে গেল। এখন প্রথমকে ডাকার পালা, আমি দোয়া পড়ছি, ডাক পড়লো মালিনীর, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখ মুছতে মুছতে ডিব্বাডুব্বির কাছে গেলাম, মুড়ি, চানাচুর, টমেটো, পিয়াজ, তেল ইত্যাদি যেমন ছিল তেমনই আছে, শুধু নাই আমার টাকার ডিব্বাটা। কান্নাটা চেপে রাখতে পারলাম না, হাউমাউ করে কেদে দিলাম।
চতুর্থ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষাই আমার জীবনের প্রথম পরীক্ষা, এর আগে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা হয়েছিল কিন্তু ওটা ছিল গুরুত্বহীন। ফাইনাল পরীক্ষায়, রিপন প্রথম, দিলু দ্বিতীয়, বোরহান তৃতীয় হল, আবু সাঈদ চতুর্থ এবং সমির পঞ্চম হল, আমি হলাম অষ্টম। শুরু হল পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস, এখন আর খারাপ লাগে না,অনেক বন্ধু বান্ধব হয়ে গেছে। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমিও নিচ্ছি। পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার পর পরই বৃত্তি পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় আগের রেজাল্টেরই পুনরাবৃত্তিই হল, কিন্তু আমার অবস্থান এক এগিয়ে সপ্তম হল। উঠলাম ক্লাস সিক্সে। আমাদের ফাস্ট বয় অন্য একটা সরকারি স্কুলে চলে গেল, নুতন বন্ধুত্ব হল অন্যদের সাথে। সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় দিলু ফাস্ট হল এবং সেও চলে গেল সেই সরকারি স্কুলে, আমি হলাম চতুর্থ। ক্লাস সেভেনে আবু সাঈদের সাথেই আমার বেশি খাতির, কারণ অন্যরা স্কুল ছেড়ে চলে গেছে। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় সাঈদ হল প্রথম আর আমি দ্বিতীয়, কিন্তু সাঈদও সেই সরকারি স্কুলে চলে গেল। আমার রোল নাম্বার হল এক, সবাই একটু দাম দেয়, ক্লাস ক্যাপ্টেনও হলাম। ক্লাস এইটে খুব শান্তিতেই কাটতে লাগলো, কোন প্রতিদ্ব›দ্বী নাই হেসে খেলেই ফাস্ট হচ্ছি। হটাৎ কোথা থেকে যেন দুইজন ভালো ছাত্র এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হল, মোস্তফা এবং এনামুল। আমার হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেল, ঘুম হারাম হলো। যাইহোক এইটের ফাইনাল পরীক্ষায় কোন রকমে মান সন্মান বাচলো, আমি ফাস্ট হলাম আর এক নাম্বার কম পেয়ে মোস্তফা সেকেন্ড হলো। ক্লাস নাইনে উঠলাম, বন্ধু বান্ধব সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম, কেউ সাইন্স, কেউ আর্টস আবার কেউ কমার্স নিল, আমার মালিনী বন্ধুটি কমার্স নিল। নুতন অনেক ছাত্র স্কুলে ভর্তি হল, নুতন অনেক বন্ধু হল। এদের মধ্যে টুটুল বলে একজন সুদর্শন বালক এলো, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওরা নাকি পাকিস্তানে বন্দী ছিল। অসাধারণ মেধাবী একটা ছেলে, পড়াশোনা বাদেও অনেক কিছু জানে, পৃথিবীর অনেক দেশ, রাজধানী আর মুদ্রার নাম তার মুখস্থ। তার সাথে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হল। পড়ালেখার পরিমাণ একটু বাড়িয়ে দিলাম। অনেক কষ্টে টুটুলের চেয়ে তিন নাম্বার বেশি পেয়ে ক্লাস টেইনে উঠলাম। টুটুলের মন খুব খারাপ, ও` জীবনে কখনো সেকেন্ড হয়নি। খালা খালু ওকে খুব বকা দিচ্ছে। স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষায় অর্থাৎ ক্লাস টেইনের ফাইনাল পরীক্ষা বা টেস্ট পরীক্ষায় ও`আমার থেকে তিন নাম্বার বেশি পেয়ে ফাস্ট হল। আমার মন খুব খারাপ আর ও` মিটি মিটি হাসছে। রাজার রাজ্য হারানোর কি যে ব্যথা, আজ তা আমি বুঝলাম। অন্যদের নিয়ে আমি চিন্তা করি না, কারণ নোবেল উপন্যাস পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোস্তফা ঘর থেকে পালিয়েছে, আব্বা মারা যাবার পর থেকে শাহীন ইমামের রেজাল্ট অতো ভাল হচ্ছে না, চিন্তা শুধু টুটুলকে নিয়েই। এস,এস,সি ফাইনাল পরীক্ষায় টুটুলের চেয়ে তিন নাম্বার বেশি পেয়ে আমি এগিয়ে রইলাম। এইভাবে তার সাথে আমার প্রতিদ্ব›দ্বীতা চলতেই লাগলো। একই কলেজে ভর্তি হলাম, সেখানেও দুজনার প্রতিদ্ব›দ্বীতা। জীবন যুদ্ধেও আমাদের মধ্যে প্রতিদ্ব›দ্বীতা হচ্ছে, কর্মজীবন শুরুতেই সে আমার আগে বিয়ে করে আমাকে পরাজিত করলো, কিন্তু আমিই প্রথম কন্যা সন্তানের জনক হয়ে তাকে পরাজিত করলাম। হয়তোবা সারাজীবন আমাদের মাঝে প্রতিযোগিতা চলবেই।
ক্লাস নাইনের প্রথম দিকে একবার স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, সবাই ব্যস্থ কিছু একটা করার জন্য, আমি কৌতুকে নাম দিলাম, কেউবা কবিতা আবৃতি করবে, একজন সাপুড়ে নাচ দেখাবে, কেউবা উল্টো খবর পড়বে। আমাদের একজন বন্ধু ছিল, নাম সাইফুদ্দিন শোয়েব, খুবই সহজ সরল ছেলে, আম্মা ওকে খুব পছন্দ করতো। সে নাম দিল হামদ ও নাতে। একদিন স্কুলে রিহার্সেল হচ্ছে, যে যা করবে তা সবার সামনে করে দেখতে হবে। সামনের চেয়ারে হেডস্যার বসা, অন্যান্য স্যারেরাও আছেন, সাত্তার স্যার খুব ব্যস্থ, কারণ উনি সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আছেন। একে একে সবারই ডাক পরছে, শেষে ডাক পড়লো আমার সেই বন্ধু শোয়েবের। ঘোষণা হল, এখন একটি হামদ ও নাতে রসুল পরিবেশন করবে, সাইফুদ্দিন শোয়েব, সে কাশিটাশি দিয়ে মঞ্চে উঠলো, তারপর শুরু করলো, " আহা একটি মেয়ে আমি দেখেছি সেদিন, এলো চুলে জানালার দাঁড়িয়ে ছিলো, বিকেলের সোনা রোদে চোমকে এসে, অনুরাগে দেহখানি জড়িয়ে ছিলো। " গানটা শুনে স্যারেরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো, হেড স্যার মাথা নিচু করে বসে রইলেন, ছাত্ররা হাসাহাসি শুরু করলো। সাত্তার স্যার কেমন যেন বিব্রতবোধ করলেন, শেষে বললেন, হয়েছে হয়েছে, অন্য একজন আসো।
সুত্র-মির্জা নূর আহমেদ-এর ফেইসবুক থেকে
---------- চলবে -----------

ডেইলি খবরের সর্বশেষ নিউজ পেতে Google News অনুসরণ করুন।
আপনার মতামত লিখুন :