মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

দেশে মব থামানোর নির্দেশ আছে, কার্যকর পদক্ষেপ নেই-আসক

আইন-অপরাধ ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ১০:৪৮ এএম

দেশে মব থামানোর নির্দেশ আছে, কার্যকর পদক্ষেপ নেই-আসক

দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা বা মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অন্তর্বতী সরকারের গত ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে ও গণপিটুনিতে সারাদেশে ১৭৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে গতকাল সোমবার ২৩ জুন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৩ জন। 
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এই হিসাবের মতো পৃথক হিসাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনও (এমএসএফ)। তাদের হিসাবে গত ৮ মাসে এ ধরনের ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৫০ জন। আহত হয়েছেন ৩৬৩ জন। নভেম্বর ও ডিসেম্বর হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে নেই।  এমএসএফের হিসাবে ২০২৩ সালে এ ধরনের ১৪৩টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, একের পর এক মবের ঘটনা ঘটলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সরকারের বিবৃতি ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার পরও মব চলছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একাধিকবার মবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। খোদ পুলিশ সদস্যরা এখনও মবের শিকার হচ্ছেন। আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া ও বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও, হামলা করা হচ্ছে।  গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৪৭৭টি মামলা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮,ফেব্রæয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ ও মে মাসে ৬২টি। এই পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে। 
সর্বশেষ রোববার উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার বাসায় মবের ঘটনায় গতকাল ২৩ জুন সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে পুলিশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে বলে জানিয়েছে। নূরুল হুদার ঘটনার পর রোববার রাতে এক বিবৃতিতে অন্তর্র্বতী সরকার জানায়, মব সৃষ্টির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন করার অভিযোগে নূরুল হুদা ছাড়াও সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রোববার দুপুরে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টা পর মব সৃষ্টি করে নূরুল হুদাকে হেনস্থা করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতাকর্মীর যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। 
গত ২২ জুন নূরুল হুদার উত্তরার বাসায় গিয়ে দারোয়ান ফেরদৌস হাসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সমকালকে বলেন, রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ৪০-৪৫ জনের একটি দল গেট খোলা পেয়ে অতর্কিতভাবে বাসায় ঢুকে পড়ে। তারা স্যারকে বলেন, আপনার নামে মামলা হয়েছে, আমরা আপনার নিরাপত্তা দিতে এসেছি। এই বলে স্যারকে জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনে।     এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যতবড় অপরাধীই হোন না কেন, তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুন্ন থাকে। নূরুল হুদার ঘটনায় বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য যে ক’জন ব্যক্তি দায়ী তার মধ্যে নূরুল হুদা অন্যতম। 
নূরুল হুদার ঘটনায় গতকাল সোমবার গাজীপুরের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন,‘তাঁর সঙ্গে যেটা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে নূরুল হুদার ওপর হামলা হচ্ছে। এর জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কারা জড়িত,এটা দেখা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ 
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন,৫ আগস্টের পর মানুষের আকাঙ্খা ছিল,ন্যায্য শাসন দেখতে পাবে, অরাজকতা থাকবে না, কাউকে অসম্মান করা হবে না, সবাই ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু ১০ মাস পর এসে রোববারও একজন মানুষকে বর্বরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কোনো পক্ষ ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতদিন পরও মব সন্ত্রাস বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। এসব ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।   
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের উপস্থিতিতে মবের ঘটনা ঘটলে তো আর আইনের শাসন থাকল না। মব সন্ত্রাসে জড়িতরা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? নিশ্চয়ই না। তাহলে কোথা থেকে তারা ইন্ধন পাচ্ছে? মব বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলো কেন সরকারকে জোরাল তাগিদ দিচ্ছে না? এভাবে আবারও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে।
তৌহিদুল হক বলেন, ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, কে মবের শিকার হবে, কারা হামলা চালাবে, কে মামলা করবে, কে ভিডিও করবে– সব যেন পরিকল্পিত। তবে মব হলো সংক্রামক ব্যাধির মতো। এখনই এটাকে দমন করা না গেলে এমন পরিস্থিতির শিকার যে কেউ হতে পারেন।  
নূরুল হুদার বাসায় যারা মব সৃষ্টি করেছিলেন,তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে আছেন– উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মো. হানিফ, থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তোহা ইসলাম মুন্না, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মোজাম্মেল হক ঢালী ও কাইয়ুম। নূরুল হুদার গলায় জুতা পরিয়ে গালে জুতা মারেন মোজাম্মেল হক ঢালী। ঘটনার পর একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে মোজাম্মেল বলেন, ‘শনিবার রাতেই তথ্য পাই– নূরুল হুদা ৫ নম্বর সেক্টরের ১-এ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাড়িতে অবস্থান করছেন। স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ ফরিদ হোসেনের নির্দেশে নূরুল হুদা যাতে পালাতে না পারেন, সে জন্য তাঁকে নজরদারিতে রেখেছিলাম। পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাধারণ জনগণের সহযোগিতায় তাঁকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’  
গত ২৪ জুন সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শেখ ফরিদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘রোববার সন্ধ্যায় আমি ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই উত্তেজিত জনতা নূরুল হুদাকে আটক করে। তবে কেউ যাতে আইন নিজ হাতে তুলে না নেয়, সে জন্য স্বেচ্ছাসেবক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয় সেখানে যাওয়ার জন্য। তারা গিয়ে জনতার হাত থেকে নূরুল হুদাকে রক্ষা করে। পরে থানায় যোগাযোগ করে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁকে মারধর করা হয়নি। এটা বানোয়াট। মারধরের ভিডিও আমার চোখে পড়েনি।’ 
স্বেচ্ছাসেবক দলের এ নেতা বলেন, ‘এ ঘটনায় সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। যদি আমাদের নেতারা নূরুল হুদাকে হেনস্থা করে থাকে, তা তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযুক্ত মোজাম্মেল হক ঢালী স্বেচ্ছাসেবক দলের কোনো পদে নেই বলে জানান শেখ ফরিদ হোসেন।  
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাসায় ঘেরাওয়ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। নাম-পরিচয় জানার জন্য মাঠে একাধিক টিম কাজ করছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে। 
পুলিশের সামনেই নূরুল হুদাকে মারধর বিষয়ে পুলিশের উপকমিশনার বলেন,সেখানে দুই-আড়াইশ লোক ছিল। খবর পাওয়ার পরপরই ওই এলাকায় মোবাইল ডিউটিতে থাকা পুলিশের তিন সদস্য সেখানে ছুটে যায়। দ্রæত পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করেছে। এত লোকের মধ্যে তিনজন পুলিশের কী করার ছিল? ১০-১৫ মিনিট বিলম্ব হলে আরও বড় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটত।সরকারের নীরবতা সহিংস গোষ্ঠীগুলোর অপকর্মে প্রভাব জোগাচ্ছে
মানবাধিকার সংগঠন আসক এক বিবৃতিতে বলেছে,কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ সংবিধান ও আইনি প্রক্রিয়া। বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি-অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।বিবৃতিতে বলা হয়, কেএম নূরুল হুদাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজের দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।
আসক বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনায় কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে। অপরাধের বিচার আইন অনুযায়ী হতে হবে-মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে। বিচার ছাড়া মব বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ। 
বিবৃতিতে এসব ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অন্তর্র্বতী সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।সমকাল

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!