মুখোশপড়া ভদ্রশেী দুর্নীতিবাজ ছিল সাঈদ খোকন। শেখ হাসিনার দয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটিকরপোরেশনের মেয়রও হয়েছিলেন। সুযোগ পেয়ে লুটপাটও করেছেন। লুটের সুবিধা নিতে ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে ১৯ পরিচালকের ১৩ জনই নিজের লোক করেছেন।
বীমা খাতে শৃঙ্খলার অভাব এবং একক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছে ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন এবং নিজ মালিকানাধীন কোম্পানির নামে শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। তার পরিবার এখন প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ২১ শতাংশের শেয়ারের মালিক। এর সঙ্গে সাঈদ খোকনের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর শেয়ার যোগ করলে মালিকানা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৯ শতাংশে, যা দেশের বীমা আইন অনুযায়ী স্পষ্টতই বেআইনি। কেননা আইনে বলা আছে,একটি কোম্পানিতে একই পরিবারের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকা যাবে না।
বীমা খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন একটি প্রতিষ্ঠান একক ব্যক্তি বা পরিবারের কবলে চলে যায়, তখন তা গ্রাহকের আস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অপেশাদারিত্ব বেড়ে যায়, যা পুরো খাতের জন্যই হুমকিস্বরূপ।
ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের বীমা খাতের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। ২০০৯ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। শুরুর দিকে এটি নিয়মনীতি মেনে পরিচালিত হওয়ায় গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে সাঈদ খোকনের আগমনের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম,স্বজনপ্রীতি এবং শেয়ার কারসাজি বেড়ে যেতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ২০১২ সালে সাঈদ খোকন কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২ বছর ধরে কোনো বৈধ নির্বাচন ছাড়াই তিনি একই পদে বহাল রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ভাইস চেয়ারম্যান পদেও তিনি নিজের চাচা মোহাম্মদ ইসমাইল নওয়াবকে বসিয়ে দিয়েছেন। এভাবে পুরো পরিচালনা পর্ষদকে ব্যক্তিগত ইচ্ছামতো পরিচালিত করে চলেছেন।
ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১৫টি। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ শেয়ার নিজের নামে রেখেছেন সাঈদ খোকন। শেয়ারের পরিমাণ ৩২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৩। এর বাইরে তার স্ত্রী ফারহান সাঈদ ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ শেয়ার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্পন্সর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাঈদ খোকনের তিন মেয়েও এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, যাদের সম্মিলিত শেয়ারের পরিমাণ ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ ছাড়া নিকটাত্মীয় সোহানা ইশতিয়াকও ২ শতাংশ শেয়ার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
অথচ বীমাকারীর মূলধন ও শেয়ার ধারণ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের শেয়ার দখল ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। একই সঙ্গে নিবন্ধন প্রবিধানমালা অনুযায়ী,পরিচালনা পর্ষদে দুজনের বেশি পরিবারের সদস্য থাকতে পারবে না। ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে এ দুই বিধিরই প্রকাশ্য লঙ্ঘন ঘটলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকসহ মোট ১৯ জন পরিচালক রয়েছেন। এর মধ্যে সাঈদ খোকনের পরিবার ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচালকই ১০ জন। এ ছাড়া চাচাকে ও প্রতিষ্ঠানটির অডিট ফার্মের দুই মালিকের স্ত্রীকে করা হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালক। তারা হলেন সাঈদ খোকনের চাচা হুমায়ন কবির এবং কোম্পানির নিরীক্ষক মহফিল হক অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার ওয়াসেকুল এইচ রিগানের স্ত্রী ব্যারিস্টার তানহা জারীন আহমদ ও অন্য পার্টনার মিয়া ফজলে করিমের স্ত্রী আকিলা নাজনীন। সব মিলিয়ে সাঈদ খোকনের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই ১৩ জন। এই ১৯ পরিচালকের মধ্যে সাঈদ খোকন, আবদুল খালেক মিয়া ও নুর মোহাম্মদের নামে জুলাই হত্যাকান্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা চলমান।
তথ্য বলছে, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) নিয়েও অসংখ্য অনিয়ম রয়েছে। এজিএম অনুষ্ঠিত হয় নামমাত্র। সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ডাক দেওয়া হয় না, তাদের মতামত নেওয়া হয় না এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় চেয়ারম্যানের একক ইচ্ছার ভিত্তিতে। এতে করে শেয়ারহোল্ডাররা একেবারে অবহেলিত। তারা জানতেই পারেন না কীভাবে কোম্পানির মুনাফা, লোকসান বা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ৮ জন উদ্যোক্তা পরিচালককে বিগত কয়েক বছরে কোনো কারণ ছাড়াই অপসারণ করা হয়। তাদের পরিবর্তে নিয়োগ দেওয়া হয় সাঈদ খোকনের স্ত্রী, দুই নাবালক কন্যা, শালিকা এবং তার মালিকানাধীন কোম্পানির মনোনীত প্রতিনিধিদের। ফলে একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ভিন্নমতের প্রয়োজন, সেখানে একক ও পারিবারিক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে, যেখানে কোম্পানি আইনে বলা আছে, স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মচারী বা পরিবারের সদস্য হতে পারবেন না। এখানে স্পষ্টতই এই বিধি লঙ্ঘন হয়েছে।
এ ছাড়া এই পরিবারের সদস্যরা, যারা কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন বা ছিলেন, তাদের অনেকে সভায় অংশগ্রহণ না করেও মোটা অঙ্কের সভা ভাতা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানকালেও তারা এসব ভাতা গ্রহণ করেন, যা কোম্পানির অর্থের অপচয় এবং নৈতিকতার চরম ব্যত্যয়।
সূত্র বলছে, ২০২০ সালের মার্চে কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় হাইব্রিড পদ্ধতিতে পর্ষদ সভায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কভিড পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পরও এ পদ্ধতি বাতিল করা হয়নি। এই সুযোগে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা অনলাইনে পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। পরে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাইব্রিড মিটিং বাতিল করা হয়। কিন্তু ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাঈদ খোকন ৫ আগস্ট-পরবর্তী কোনো মিটিংয়েই সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে তিন মাসের বেশি সশরীরে উপস্থিত না থাকলে চেয়ারম্যান পদে থাকতে পারার কথা নয় সাঈদ খোকনের। কিন্তু তিনি এখনো প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় প্রভাব খাটিয়ে ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন সাঈদ খোকন। যদিও মেয়র থাকা অবস্থায় লাভজনক কোনো পদে থাকা পুরোপুরি বেআইনি।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মুজাহিদল ইসলাম শাহীন বলেন, বীমা আইন ২০১০-এর ৭৮ ধারা মোতাবেক কোনো ব্যক্তি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে তাহলে তিনি কোনো বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো মেয়র বীমা কোম্পানির পরিচালক বা সভাপতি বা চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না বা আইনগতভাবে সুযোগ নেই।
সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ সিংহভাগ পরিচালকই পলাতক রয়েছেন। এরই মধ্যে ছয়টি বোর্ড মিটিং হলেও তাতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন পরিচালক। তবে স্বাক্ষর স্ক্যানে সব পরিচালককেই এসব বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত দেখানো হয়।
তথ্য বলছে, সাঈদ খোকন কোম্পানির পুরোনো প্রধান কার্যালয় বিক্রি করে নতুনভাবে বনানীতে তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবনে অফিস স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন। এতে কোম্পানির স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পুরানা ও নয়াপল্টন এলাকায় কোম্পানির দুটি স্পেস বিক্রি করা হয়েছে অবমূল্যায়নে, যার সঠিক হিসাবও নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল খালেক মিয়াকে বেআইনিভাবে অপসারণ করা হলে গত ২০ আগস্ট তিনি এ বিষয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করেন। পরে আইডিআরএ অপসারণ বাতিল করে তাকে পুনরায় বহাল করে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি থাকলেও হঠাৎ তাকে এভাবে অপসারণ করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
জানতে চাইলে ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের সদ্য সাবেক সিইও আব্দুল খালেক মিয়া বলেন, আমি এই কোম্পানিতে জয়েন করার পর থেকে বিভিন্ন অনিয়ম দেখতে পাই। কিন্তু এসব অনিয়ম আমি কোনোভাবেই করতে দেব না জানানোর কারণেই আমার ওপর তারা অনেকদিন থেকে ক্ষুব্ধ ছিল। এজন্যই আমাকে অপসারণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আইডিআরএ এই অপসারণ বাতিল করে আমাকে ফের বহাল করেছে। যদিও তারা আমাকে বরখাস্ত করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাঈদ খোকনসহ পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে থাকা তার পরিবারের সবাই পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন,আমরা বেশ কয়েকজন মিলে ইসলামী ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক সমস্যার কথা বলে ২০১২ সালের দিকে তিনি চেয়ারম্যান পদে বসেন। এরপরই তার চিন্তায় পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। তিনি একে একে সাবেক সব পরিচালককে কোনো কারণ ছাড়াই সরিয়ে দেন। এসব জায়গায় তার আত্মীয়স্বজনদের পরিচালক হিসেবে বসান। এক কথায়, একটি ভালো বীমা কোম্পানিকে তিনি দখল করে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) মুখপাত্র সামসুন্নাহার সুমী বলেন,ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের অনেক অনিয়ম সম্পর্কে আমাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ জমা হয়েছে। এরই মধ্যে আইডিআরএ থেকে তদন্ত চলমান আছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পলাতক থাকায় খোকনের কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।সংগৃহীত
আপনার মতামত লিখুন :