রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এবার পাল্টা চাপে

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৫, ১০:৩৩ এএম

এবার পাল্টা চাপে

পদত্যাগের ভাবনা প্রকাশ্যে আশায় পাল্টা চাপে অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্র্বতী সরকার ৯ মাস পার করল; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য এবং রাজপথে প্রতিদিনের আন্দোলনে এখনো সুস্থির হতে পারছে না। এর মধ্যেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছেন এমন খবর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সরকার ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় আলোচনায় উঠে এসেছে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি।প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনার খবর এমন এক সময়ে ছড়াল, যখন কয়েকজন উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বিভিন্ন শক্তি। সেই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের মন্তব্য যেন নতুন মাত্রা যোগ করেছে এতে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন,নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে চতুর্মুখী চাপের কারণে বিরক্ত হয়েই পদত্যাগের কথা ভাবছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিষয়টিকে রাজনৈতিক মহলের ওপর পাল্টা চাপ হিসেবেই দেখছেন তাঁরা। ড. ইউনূসের পদত্যাগের সম্ভাবনা সত্যি হলে অন্তর্র্বতী সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন ও উপদেষ্টাদের নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে জাতীয় সরকারের বিষয়টি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার পরিবর্তে যদি তিনি (ড. ইউনূস) পদত্যাগ করতে চান বা দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় হতে পারে। আমরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করিনি। আর একান্তই যদি উনি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব পালনে অপারগ হন, তাহলে রাষ্ট্র তো বসে থাকবে না। রাষ্ট্র তো একটা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নেবে।’
এদিকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে বাধাগ্রস্থ করে আরেকটা এক-এগারোর বন্দোবন্ত করার পাঁয়তারা চলছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ২৩ মে শুক্রবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে এসব কথা বলেছেন তিনি।এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নাহিদ। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্র্বতী সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম। এ তিনজনই জুলাই অভ্যুত্থানের পরপর গঠিত অন্তর্র্বতী সরকারের কুশীলব হিসেবে পরিচিত।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি খবর পেয়েছি যে ড. ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যই আজ সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম।’নাহিদ এই মন্তব্যের পরপরই নড়েচড়ে বসেছে সব মহল। সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে।জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশ সংকটে আছে। এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের ডাকে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেই রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক বসে। এতে অংশ নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ আরও পাঁচটি রাজনৈতিক দল। বৈঠকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং একটি সম্মিলিত কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট ও জটিল পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগ নয়, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষকে সমঝোতামূলক সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন।আবার একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক আলটিমেটাম না দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব লেখেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। তাঁর ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অধ্যাপক ইউনূসের দরকার আছে।’ এরপর বিকেল পৌনে ৪টার দিকে তিনি পোস্টটি মুছে দিয়ে আরেকটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন,‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা স্যারের বিষয়ে দেওয়া স্ট্যাটাসটি আমার ব্যক্তিগত মতামত।’
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং বাইরের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মন্তব্যের কারণে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্যের সুযোগেই এমন পরিস্থিতি দানা বাঁধছে।এ অবস্থায় গতকাল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, শুধু নির্বাচন করার জন্যই তাঁরা দায়িত্ব নেননি। তাঁদের তিনটি দায়িত্ব। এর একটি সংস্কার,অন্যটি বিচার, আরেকটি নির্বাচন। রিজওয়ানা হাসানের এই বক্তব্যের পরও নানা আলোচনা শুরু  য়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে,বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত’সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন বক্তব্যের পর। সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের পরই সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্যের বিষয়টি সামনে চলে আসে, যা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।এর বাইরে সরকারের একজন উপদেষ্টার নানা কর্মকান্ড নিয়েও সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর টানাপোড়েন শুরু হয়; যা ধীরে ধীরে জটিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও ড. খলিলুর রহমানের পদত্যাগ এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বেকায়দায় পড়ে সরকার।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন,এমন নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়টিকে সামনে আনা হয়; যাতে করে বিএনপি পাল্টা চাপে পড়ে। এ নিয়ে অবশ্য পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও দিয়েছেন এনসিপি ও বিএনপির নেতারা।এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম গতকাল বলেছেন, বিএনপির আন্দোলনের চাপে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা এসেছিল।তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চায় না। তবে আবেগের বশে থাকতে না চাইলে বিকল্প বেছে নেবে দেশের জনগণ।
দেশের এই জটিল পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ড. ইউনূসের মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত এ ধরনের বক্তব্য বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। বিএনপি কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের কথা কিছুই বলেনি। সরকারের সমস্যা হলো সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বসছে না, ফলে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে।সূত্র বলছে,গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ যমুনায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি এক উপদেষ্টাকে তাঁর বর্তমান কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া অথবা দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং রাজনৈতিক দলগুলো এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলাদা সভা করার পরামর্শ দেন।
আলী রীয়াজ চলে আসার পরই নাহিদ ইসলাম যান প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায়। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন নাহিদ ইসলাম, সঙ্গে ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।বৈঠকের পর নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, যদি কাজ করতে না পারেন, থাকবেন না, থেকে কী লাভ?’ তিনি বলেন, ‘উনি বলেছেন, উনি এ বিষয়ে ভাবতেছেন। ওনার কাছে মনে হয়েছে পরিস্থিতি এ রকম যে তিনি কাজ করতে পারবেন না। এখন রাজনৈতিক দল তার পদত্যাগ চায়...সে আস্থার জায়গা, আশ্বাসের জায়গা না পেলে উনি থাকবেন কেন?’
এদিকে চলমান এই গুমট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজধানীর রমনা এলাকার একটি বাসায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঐকমত্য পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। অবশ্য বৈঠকের বিষয়টি কোনো দলের পক্ষ থেকে কেউই নিশ্চিত করেনি। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, তাঁরা মনে করছেন, মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে ১৪ থেকে ২২ মে পর্যন্ত ৯ দিন রাজধানীতে কর্মী-সমর্থকদের টানা উপস্থিতির মাধ্যমে মাঠের রাজনীতিতে শক্তি দেখাতে পেরেছে। এর মাধ্যমে অন্তর্র্বতী সরকারকে আরও বেশি চাপে ফেলা সম্ভব হয়েছে।এ ছাড়া ইশরাককে মেয়র পদে শপথের পক্ষে উচ্চ আদালতের রায়কেও ‘জয়’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতারা। তাঁরা এবার আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে ঈদুল আজহার পর রাজপথে কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে চান। এদিকে দেশের একাধিক রাজনৈতিক সুত্রগুলো জানায় রাজনৈকিত দলগুলোর সাথে ঈদের আগেই ঐকমত্য না আসতে পারলে নির্বাচনের রোড ম্যাপ নিয়ে ঈদের পরে রাজনীতির মাঠের তাপ বাড়তে পারে।

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!