দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। চলতি বছর চিকিৎসাধীন যত রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের (৭৩ শতাংশ) বেশির মৃত্যু হয়েছে সরকারি সাত হাসপাতালে। আর তাদের বেশির ভাগই ভর্তি হওয়ার এক দিনের মধ্যেই মারা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরু থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৫৮ হাজার ২৮০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর ১৮টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এবং ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ হাজার ১৪২ জন রোগী। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪৩ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
সরকারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের সাতটি বড় সরকারি হাসপাতালেই বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ১২ হাজার ৬৭০ জন ডেঙ্গু রোগী, যা মোট ভর্তির প্রায় ২২ শতাংশ। এসব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ১৭৭ জন রোগী, যা মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশ। হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল,মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ডিএনসিসির ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ভর্তি এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান উভয়েই ইঙ্গিত দেয়, এসব প্রধান হাসপাতালে মূলত জটিল অবস্থার রোগীরাই এসে থাকে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে বছরজুড়ে ২ হাজার ৩৪০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ভর্তি রোগীর ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। দেশে এই হাসপাতালেই এককভাবে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. আসাদুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা আসে, তারা মূলত বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে আসা রেফার্ড কেস। এদের বেশির ভাগেরই কোমরবিডিটি (একাধিক দীর্ঘমেয়াদি রোগ) থাকে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বেশির ভাগ রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছে।’
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৩৭৮ জন রোগীর মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। শতকরা হিসাবে ভর্তির বিপরীতে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘এখানে মূলত সংকটাপন্ন রোগীরাই ভর্তি হয়। বেসরকারি হাসপাতাল সাধারণত জটিল রোগী ভর্তি নেয় না।’
চলতি বছর রাজধানী ছাড়া এককভাবে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। রাজধানীর বাইরে ধরলে এই বিভাগেই ভর্তি রোগীর মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি—৩৫ জন। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৬৮৪ জন রোগীর মধ্যে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তি রোগীর তুলনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এ কে এম মশিউল মুনীর বলেন,‘রোগীরা ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার সাত-আট দিন পর হাসপাতালে এসে থাকে। আমাদের আইসিইউ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধাও সীমিত।’
অন্য প্রধান সরকারি হাসপাতালের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৬১। এর মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তির বিপরীতে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার ১ দশমিক ২৯ শতাংশ। মুগদা মেডিকেলে মারা গেছে ৩৪ জন, মৃত্যুহার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ডিএনসিসির ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৪৭২ জনের মধ্যে মারা গেছে ১৮ জন, মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ১ হাজার ২৬১ জন রোগীর মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যুহার ১ দশমিক ২ শতাংশ।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘রোগীরা কেন দেরিতে হাসপাতালে আসছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষায় কোনো ঘাটতি থাকলে তা দ্রæত ঠিক করতে হবে।’ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ডেঙ্গু থেকে নিজেদেও মুক্ত রাখেতে হলে সচেতনার বিকল্প নেই। পানি যেনো কোথায় জমা রাখা যাবে না। পরিস্কারপরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রাখতে হবে ঘরবাড়ি ও আঙিনায়।
আপনার মতামত লিখুন :