বিশেষ প্রতিবেদক: ‘জুলাই জাতীয় সনদ২০২৫’বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তির জন্য সরকারকে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।এই প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হবে। তবে এই ‘সংবিধান আদেশ’ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত পরামর্শ বা অভিমত পাওয়া গেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কমিশনের পক্ষ থেকে বুধবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সনদ বাস্তবায়নে এর আগে বিশেষজ্ঞদের বিকল্প দুটি সুপারিশ ছিল। যা হলো ‘গণভোট’ এবং ‘সংবিধান আদেশ’। সেখানে তারা সমন্বিত একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
এর আগে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উঠে আসে। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন অনিশ্চিত বা বাধাগ্রস্থ হলে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং অসাংবিধানিক শক্তি লাভবান হবে। এ সময়ে তিনি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নিয়ে (জামায়াতসহ অন্যান্য দল) রাজপথ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানান।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে। তিনি বলেন,আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। নির্বাচন কমিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে আগামী ১২ ফেব্রæয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদে মোট ৮৪ ধারা বা সিদ্ধান্ত আছে। এরমধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে তিন ধরণের প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। আর প্রায় ৩৪টি ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অধ্যাদেশ দিয়ে যে সব ধারা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেক্ষেত্রে সব দল একমত। তবে যে সব ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে,সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিভক্তি আছে। বিএনপি বলছে, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। ফলে আগামী নির্বাচিত সরকার পরর্র্বতী দুই বছরের মধ্যে সংবিধান সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে।
জামায়াতে ইসলামী বলছে,গণভোট অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এনসিপি চায় গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলাম আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় বিলম্ব না করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে যাচ্ছে কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদের সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত পরামর্শ বা অভিমত পাওয়া গেছে। এর আগে তাদের দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল। তা হলো ‘গণভোট‘ এবং ‘সংবিধান আদেশ‘। এ পর্যায়ে সমন্বিত করে তারা একটি চূড়ান্ত অভিমত দিয়েছেন।
এতে তারা বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ দফা অনুসরণ করে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদের সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো কার্যকর করা যায়। এই ‘সংবিধান আদেশ’ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করতে পারে। গণভোট আয়োজনের বিষয়টি ‘সংবিধান আদেশে’ উল্লেখ থাকবে। আর গণভোট আগামী সংসদ নির্বাচনের একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের (আগামী রোববার) মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় কমিশন। কারণ ওইদিন প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। এই তারিখের মধ্যে না পারলে ২ অক্টোবর পরে চলে যেতে পারে। কারণ ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরবেন। তবে এ সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। এ সময় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় যোগ দেবেন।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, সনদ বাস্তবায়নে চারটি পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে রয়েছে- নির্বাহী আদেশ, অধ্যাদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়ানো হয়েছে। কমিশন কোনো অবস্থাতেই এক মাস সময় নিয়ে এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী নয়। আমরা খুব দ্রæত একটা ঐকমত্যের জায়গায় উপনীত হতে পারব।
ঐকমত্য কমিশনের এই সহসভাপতি বলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশ এই দুটো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ভিন্নমত ছিল, তা কাটিয়ে উঠে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে দ্রæতই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো ৬টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— পুর্নাঙ্গ সনদ বা তার কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতাবলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন করে সাংবিধানিক ব্যবস্থা, আগামী জাতীয় সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভা রুপে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করা, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়া যে অন্তর্র্বতী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা?
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিআর নিয়ে যারা রাজপথে আন্দোলন করছেন,তা কমিশনের এজেন্ডায় ছিল না। সবার রাজনৈতিক অধিকার আছে যে কোনো বিষয়ে দাবি জানানোর, আমরাও রাজপথে আমাদের বক্তব্য দেব। তবে রাজপথে তো পিআর আদায় করা যাবে না, আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। আলোচনার টেবিল রেখে রাজপথে যাওয়া স্ববিরোধিতা।’ বিএনপির এ নেতা বলেন, আজকের বৈঠকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অভিমত উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সরকার সাংবিধানিক কি না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সংবিধান মেনে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তিনি বলেন,সনদের যেসব বিষয় সংবিধান-সম্পর্কিত, তা বাস্তবায়নের আগে বিচার বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কিন্তু জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা ঠিক হবে না। সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই মতামত দিলে বিবেচনা করা যায়। তবে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সনদে স্বাক্ষর করেই জনগণের কাছে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ থাকবেন। এমন কিছু মৌলিক সংস্কারমূলক বিষয় আছে,যা বাস্তবায়নে সংসদীয় গণভোটেরও প্রয়োজন হতে পারে। তাহলে একই বিষয়ে দুবার গণভোটের প্রয়োজন কেন? এসব বিষয় আলোচনার টেবিলেই নির্ধারিত হওয়া উচিত।’ সালাহউদ্দিন আহমদ হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘যদি নির্বাচন অনিশ্চিত হয় বা বাধাগ্রস্থ হয়, তাহলে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং অসাংবিধানিক শক্তি লাভবান হবে।’ তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে। সংসদ গঠনের পর মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় গণভোট আয়োজনের বিষয়টি তখনও বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে গড়িমসি করার কথা ছিল না। অনেকেই রাস্তায় মিছিলের উদাহরণ দিচ্ছেন। তবে সবার জানা আছে রাস্তার মিছিলের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায় হয়েছে। সুতরাং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে সরকার যদি দেরি করে অথবা অন্য কিছু হয় তাহলে আবার জনগণ রাস্তায় নামবে এটা খুবই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে এর বাইরে যাওয়ার তো কোন সুযোগ নেই। যেকোন দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যই হলো আন্দোলন সংগ্রাম লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই এগুলি বাস্তবায়িত হয়। এসময় তিনি উদাহরণ হিসেবে কেয়ারটেকার সরকারের প্রথম দিকের কথা তুলে ধরেন। সে সময় অনেকে বলছেন, কেয়ারটেকার ফর্মুলা পার্লামেন্ট কি বলে সংবিধানে সংযোজন হবে? জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচনটা করলে নির্বাচন সুষ্ঠ হবে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো এখানে স্থান পাবে। কেউ কেউ বলছেন, মৌলিক বিষয়গুলো সংসদে যাবে।আমরা বলেছি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ব্যাপারে সংসদের কোনো এখতিয়ার নাই। এটার জবাব কিন্তু উনারা (বিএনপি) দিতে পারেন নাই। তিনি বলেন, তত্বাবধায়ক সরকারের জন্য রাজপথে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু “আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই শেখ হাসিনা এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে। ঐক্যমত কমিশনে বহুবার আলোচনা হয়েছে আদালতকে আমরা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন আজ যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে সবাই একমত হলে দেশ আগামীতে সুন্দর একটি নির্বাচন পাবে।
আপনার মতামত লিখুন :