রবিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২

ময়লা ও ছেঁড়া টাকায় বাজার সয়লাব

ব্যবসা-বাণিজ্য ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম

ময়লা ও ছেঁড়া টাকায় বাজার সয়লাব

টাকায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও মানুষ হাতে নিচ্ছে একরকম বাধ্য হয়েই। রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশের মানুষের হাতে, দোকানে, যানবাহনে, ব্যাংকে ছেঁড়াফাটা ও পুরনো ময়লা নোটে সয়লাব হয়ে গেছে। টাকায় হাত দেয়া যায় না। চাহিদার তুলনায় ব্যাংকগুলোকে নতুন নোট দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে বিড়ম্বনায় পড়ছে গ্রাহক। পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন মানুষ। এ নিয়ে বাকবিতন্ডার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কাগুজে নোটের প্রচলন বেশি। এসব নোটের স্থায়িত্ব হয় ৬ থেকে ৮ মাস। এই সময়ে অধিকাংশ নোট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এদিকে সব ধরনের টাকা ও ধাতব মুদ্রায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় গত এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎ নতুন নোট বাজারে ছাড়া বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সংবলিত নতুন নোট বাজারে আসছে না। গত ঈদুল আজহায় নতুন নোট ছাপায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নতুন ছাপানো নোট বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ নতুন নোট ছাপানোই হয়েছে কম। মাত্র ৫২০ কোটি টাকার বিভিন্ন নোট ছাপা হয়েছে। এতে নতুন নোটের পরিবর্তে পুরনো নোটই ঘুরছে গ্রাহকের হাতে হাতে। ফলে গ্রাহকের কাছে প্রতিদিনই বাড়ছে ছেঁড়া-ফাটা নোট।
টাকার ক্ষতি হয় যেভাবে: ব্যাংকারদের দাবি,বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলনের পরে গ্রাহকের চাহিদামতো নোটগুলো ভালোভাবে সাজিয়ে দিতে পিন মারা হয়। নোটের এক মাথায় পিন মারার ফলে টাকা গুনতেও সুবিধা হয়। আবার গ্রাহক টাকা গণনার সময় কৌশলে যাতে টাকা না সরাতে পারে, সে জন্য পিন ব্যবহার করা হয়।
এই পিন মারার ফলে টাকার বেশি ক্ষতি হয়। আবার পিন মারা বা স্ট্যাপলিং করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শাখায় বড় মেশিনও রাখে। অন্যদিকে পিন মারার ফলে ব্যাংক নোটের স্থায়িত্ব কমে যায়। তবে বর্তমানে টাকায় পিন মারার হার কম। 
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশাল মে মাসে নতুন নকশার নোট ছাপায়। প্রথম ধাপে ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নতুন নকশার নোট বাজারে ছাড়ে। নতুন নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পরিবর্তে যুক্ত হয় ধর্মীয় স্থাপনা, বাঙালি ঐতিহ্য সহ জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি। তবে সব ধরনের টাকা ও ধাতব মুদ্রায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় গত এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎ নতুন নোট বাজারে ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ঈদুল আজহায় নতুন নোট বাজারে ছাড়া হয়। 
টাকশালের এক কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত লাখ লাখ নোট এখনো বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে পড়ে আছে। এসব নোট চাইলেই হুট করে বাতিল করা যাবে না। নতুন নকশার নোট বাজারে এলে ধীরে ধীরে পুরনো নোটগুলো তুলে নিতে হবে। 
এটিএম বুথেও পুরনো নোট: শুধু মানুষের হাতেই পুরনো নোট নয়, ব্যাংকগুলোও গ্রাহকদের পুরনো নোট দিচ্ছে ও নিচ্ছে। এমনকি ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো থেকেও এখন বেশ পুরনো ও প্রায় অচল নোট বের হচ্ছে। এটিএম বুথে টাকা ফেরত দেয়ার সুযোগ না থাকায় এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। ঢাকা ব্যাংকের এক গ্রাহক মাইনুল বলেন, কার্ড দিয়ে এটিএম থেকে ২০ হাজার টাকা তুলেছি। এর মধ্যে তিনটি এক হাজার টাকার নোট প্রায় অচল। এখন এসব নোট ফেরত দিতে গেলেও ব্যাংকগুলো নিতে চাচ্ছে না।
লেনদেনে ভোগান্তি: ঢাকার বাইরের একজন শিক্ষক একটি ব্যাংকের শাখায় সঞ্চয়ী টাকা জমা দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। তিনি বলেন, ব্যাংক অফিসার (ক্যাশ) একটি ৫০০ টাকার নোটের সামান্য অংশ ছেঁড়া থাকায় তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অফিসারের স্পষ্ট কথা- ছেঁড়া টাকা কোনো অবস্থাতেই নেয়া যাবে না। ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে গিয়েও সমাধান পাননি এই শিক্ষক। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
রাজধানীর শান্তিনগর থেকে রিকশায় করে কাওরান বাজারে আসেন একযাত্রী তিনি বলেন, ভাড়া দিতে গিয়ে এক বিপত্তি। কাছে থাকা ১০ টাকার দু’টি নোট ছেঁড়া। রিকশাচালক নিতে রাজি নন। এ ছাড়া তার কাছে নেই ভাংতি। পরে ব্যাগ হাতড়ে অনেক কষ্টে খুচরো দিয়ে ভাড়া দিলাম। 
একাধিক ক্রেতা জানান দোকানে ৪২০ টাকা কেনাকাটা করে ১ হাজার টাকার নোট দেন। বিক্রেতা তাকে দুটো ২০০ টাকার নোট, একটি ১০০ টাকা, একটি ৫০ টাকা, একটি ২০ টাকা ও একটি ১০ টাকার নোট ফেরত দেন। এর মধ্যে একটি ২০০ টাকার নোট ও ২০ টাকার নোট দু’টি ছিল প্রায় অচল। দোকানদার তাকে আশ্বাস দেন, পরের মাসে ছেঁড়া টাকা নিয়ে এলে পরিবর্তন করে দেবেন। এখন এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এদিকে দোকানদাররা বলেন, আগে ব্যাংক থেকে নতুন নতুন খুচরা নোট আনা যেতো। এখন সেটি বন্ধ। ব্যাংক থেকে পুরোনো নোট যা মিলছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ছেঁড়া-ফাটা। 
জাহিদ হাসান নামের সোনালী ব্যাংকের এক গ্রাহক বলেন, নতুন নোট ব্যাংক থেকে নিতে চাইলেও দিতে পারছে না। আমাদের হাতে যে নোট আছে তা সব পুরনো। ছিঁড়ে যায় যায় অবস্থা। এসব নোট এখন বহন করাও রিস্ক। 
নতুন টাকার ব্যবসা: এদিকে চাহিদার তুলনায় ব্যাংকগুলোকে নতুন নোট দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে অনেক নোট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মানুষের হাত, দোকানে ও ব্যাংকে ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো ময়লা নোটের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন নাগরিকরা। মানুষের হাতে থাকা প্রচুর ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো ময়লা নোটের সুযোগে জমজমাট হয়ে উঠেছে নতুন টাকার ব্যবসা। গুলিস্তান ও মতিঝিল সেনা কল্যাণ ভবনের সামনের ব্যবসায়ীরা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে ছেঁড়া নোট কিনছেন। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন গ্রাহকরা। নতুন নোট বাজারে আসার এক বছর পার হয়ে গেছে। তারপরও বাজারে নতুন নোট সহজলভ্য হয়নি।
মতিঝিলে নতুন নোটের ব্যবসায়ীরা বলেন, এখন নতুন নোট বাজারে না থাকায় পুরোনো নোট বেড়েছে। অনেক অচল (ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো) নোট যেগুলো আছে সেটা আমরা বদলে দেই। আগে এ ধরনের নোট কম এলেও এখন বেশি আসছে। কাগজে ছাপানো টাকা দেশে বর্তমানে চলছে ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার কাগুজে নোট ব্যবহৃত হচ্ছে।
কাগুজে নোটের পাশাপাশি বাজারে ১, ২ ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্রাও রয়েছে। এসব মুদ্রায় বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, আগস্টে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা জুলাইয়ে ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। 
ছেঁড়া টাকা নেয়ার নির্দেশ:  তফসিলি ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা ব্যাংক নোট বা টাকা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ‘ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা নোট গ্রহণ করা হয়’ এমন বিজ্ঞপ্তি শাখার দৃশ্যমান স্থানে ও রঙিন অক্ষরে লিখে টানানোর জন্য ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। পরিপত্রে বলা হয়,ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় আবশ্যিকভাবে কাউন্টারের সামনে বা জনসাধারণের সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে ২০ ফন্টে রঙিন কালিতে লিখিত বিজ্ঞপ্তি প্রদর্শন করতে হবে।
ময়লা নোট বদলের সুযোগ: তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে ছেঁড়া-ফাটা ও পুরোনো ময়লা নোট বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে। সেখানে এর আগে পুরোনো নোটের বদলে নতুন নোট দেয়া হলে এবার বেশি পুরোনো নোটের বদলে কম পুরোনো নোট বিনিময় করা হচ্ছে। ছেঁড়া, পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্থ নোটের বিনিময়মূল্য ফেরত দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এখন থেকে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে নষ্ট হওয়া নোটের নির্দিষ্ট অংশ অনুযায়ী অর্থ ফেরত পাবেন।
নতুন বিধান: কোনো নোটের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যমান থাকলে পুরো অর্থ ফেরত দেয়া হবে। নোটের ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ থাকলে মূল্যের ৭৫ শতাংশ ফেরত। নোটের ৫১ থেকে ৭৫ শতাংশ থাকলে ৫০ শতাংশ অর্থ ফেরত। কোনো নোটের ৫১ শতাংশের কম থাকলে বিনিময়মূল্য পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া, নোট একাধিক খন্ডে বিভক্ত হলে এবং দু’টি প্রান্তের নম্বর মিল থাকলে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ নোট থাকলে ৫০ শতাংশ অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে। পোড়া নোট অখন্ডিত থাকলে এবং নোটের আয়তন কমপক্ষে ৫১ শতাংশ হলে বা খন্ডিত নোটের দুই প্রান্তোর নম্বর মিল থাকলে ৫০ শতাংশ অর্থ ফেরত দেয়া হবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, আগে ডিজাইন প্রস্তুত ছিল। শুধু টাকা প্রিন্ট করে বাজারে ছাড়া হতো। এখন সব ধরনের নোট ছাপতে হচ্ছে। আমরা যতটুকু পেরেছি, তা ছেড়েছি।সংগৃহীত
 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!