শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ২৮ ভাদ্র ১৪৩২

চোখের সামনেই শত শত কোটি ডলার চুরি: শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ০১:৪২ পিএম

চোখের সামনেই শত শত কোটি ডলার চুরি: শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র

‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই চুরি’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)। তথ্যচিত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি (২৩৪ বিলিয়ন) ডলার পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার এবং তা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। 
তথ্যচিত্রের শুরুতেই দেখানো হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে সরকারি চাকরিতে কোটা ঘিরে শেখ হাসিনার শাসন নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভ ফেটে পড়ে। এ সময়ে হাসিনা ক্রমে আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছিলেন; বিরোধীদের গণহারে কারাবন্দি করছিলেন। আর শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি এবং দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের খবর দেখে দেখে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। পাচার হওয়া এই অর্থের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছে। 
এতে দেশটির লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার পরিবারের কয়েক সদস্যও অভিযুক্ত। অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। 
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় টিউলিপ সিদ্দিক ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ফ্ল্যাট দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের শুরুর দিকে টিউলিপ মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া এফটির সাংবাদিকরা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, তিনি যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিক। 
আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ সংস্থা স্পটলাইট অন করাপশনের উপপরিচালক হেলেন টেলর বলেন, পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের একজন মন্ত্রীর জন্য যুক্তরাজ্যে অন্তত ৩০০টি সম্পত্তি কেনা বিস্ময়কর। যেখানে এক ব্যক্তি বছরে দেশের বাইরে ১২ হাজার ডলারের বেশি নিতে পারেন না। 
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ৩৫০টি সম্পত্তি শনাক্ত করে জব্দ করেছে, যা এফটির খোঁজ পাওয়া ৩০০টির বেশি সম্পত্তির সঙ্গে মিলে যায়। তথ্যচিত্রে জানানো হয়, ২০০৯ থেকে ’২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলে অন্তর্র্বতী সরকার প্রাক্কলন করছে। 
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির সাধারণ ধারা হলো, শাসক দলকে তার সমর্থকদের মধ্যে টাকা বিলাতে হয়। তা না হলে ক্ষমতায় টিকতে পারে না। আমার মনে হয়, শাসনামলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ অর্থনীতি ও নিজেদের দল দুয়েরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল।’ 
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার শাসনকালে শাসকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সাহায্যে বিভিন্ন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, কিছু ব্যাংকের পরিচালককে গোয়েন্দারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে শেয়ার হস্তান্তর কাগজে সই করিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করত। আর সেই শেয়ার যেত পুরোনো শাসকদের ঘনিষ্ঠদের হাতে। 
অন্তর্র্বতী সরকারের অনুমান, এস আলম ও তাঁর গ্রæপ বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার, এমনকি তার চেয়েও বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে। 
দুর্নীতির বিষয়টি সবাই জানত 
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন খতিয়ে দেখছে, সাবেক শাসন-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে টাকা সরিয়েছেন কিনা। এর একটি হলো পদ্মা সেতু, যে প্রকল্পে দুর্নীতির শঙ্কায় বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আরেকটি ছিল দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। 
ড. মোশতাক খান বলেন,এগুলোর কিছুই গোপন ছিল না। পত্রপত্রিকায় ছিল, মিডিয়ায় আলোচনা হতো, দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য, চোখের সামনে; কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অধিকাংশ মানুষ ছিল আতঙ্কে। তারা জানত, কথা বললে গায়েব হয়ে যেতে পারে। দুর্নীতির কথা সবাই জানত, তবু চুপ করে থাকত। 
পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে চ্যালেঞ্জ 
সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের পরামর্শদাতা ইফতি ইসলাম বলেন, ‘আপনি যখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার চুরি করেন, তখন আপনি বিশ্বের সেরা আর্থিক কাঠামোবিদ, পরামর্শক ও আইনজীবীদের ভাড়া করতে পারেন, যারা আপনার টাকা সরানো ও লুকাতে সাহায্য করেন। এটা সম্পদ উদ্ধারে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। আপনি টাকার হদিস না পেলে তা ফেরত আনতে পারবেন না।’ 
সম্পদ উদ্ধারের আরেক সমস্যা হলো, এতে প্রায়ই সমঝোতা করা লাগে। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী বা ধনকুবের টাকা চুরি করে দেশ থেকে পাচার করেছে, তার সঙ্গে চুক্তি করা। তখন একদিকে টাকা ফেরত আনা, অন্যদিকে বাংলাদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। 
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, মানুষ বলে, সব টাকা আদায় সম্ভব নয়। আমরা যেটুকু পারি, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু তার জন্য কঠিন প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে, পথ অনুসরণ করতে হবে; সংশ্লিষ্ট বিদেশি সরকারের সহযোগিতা পেতে হবে। 
এফটির এগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, যদি ইউনূস প্রশাসন অন্য দেশের সরকারগুলোকে যেমন যুক্তরাজ্যে এনসিএ যা করেছে, তেমন পদক্ষেপে রাজি করাতে পারে, তাহলে চাকা ঘুরতে শুরু করবে এবং থামানো কঠিন হবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। যারা শেখ হাসিনার আমলে অর্থ পাচার করেছে, তারা ভবিষ্যতের সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করবে, তার ওপরেই নির্ভর করবে দেশে দুর্নীতি কতটা ব্যাপক থাকবে। 
সংস্কারের ভবিষ্যৎ 
এফটির দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, বাংলাদেশের ‘বিপ্লব’ একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে হয়েছে। তবে এমনও হতে পারে, দেশ আবার এমন এক অবস্থায় ফিরে যাবে, যেখানে এক দল রাজনৈতিক শক্তির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে। তফাত শুধু এবার তা আওয়ামী লীগ নয়; বিএনপি হতে পারে। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি বলেন, ‘আমাদের ভয়, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রতি পূরণ করতে পারব না। এটাই এখন সবচেয়ে বড় আশঙ্কা।’

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!