শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উপকূলে ভারী বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানিতে দুর্যোগ

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৫, ০৯:১৯ এএম

উপকূলে ভারী বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানিতে দুর্যোগ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সারাদেশে। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূল এলাকায় দুর্যোগ দেখা দিয়েছে।এসব এলাকায় বসবাসরত বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরপানি। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। ভেঙে গেছে বাঁধ। ভাঙছে নদী। বন্ধ নৌ চলাচল। বিদ্যুৎহীন লাখো মানুষ। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে এমন অবস্থা দেশের অন্তত উপকূলীয় ১৪ জেলার।
এসব জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বিপর্যস্ত উপকূলীয় এলাকার জনজীবন। উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপ আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় এটি পটুয়াখালীর খেপুপাড়া দিয়ে উপকূল অতিক্রম করেছে। অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে।
বৃষ্টিতে রাজধানীতে সড়ক ডুবে যানজট তৈরি হয়। গতকাল রাত ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মিরপুর,মহাখালী, বিমানবন্দর সড়ক, শ্যামলী, গাবতলীসহ অনেক এলাকায় ব্যাপক যানজট ছিল।গত মঙ্গলবার সৃষ্ট লঘুচাপটি গতকাল গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। ভোর থেকে শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে ছিল ঝোড়ো হাওয়া। ফুঁসতে থাকে নদনদী। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। জোয়ারে ডুবেছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। ১ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে এসব অঞ্চল।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেছেন, নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা নেই। ২৪ মে টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটে। এটা অনেক সক্রিয়। এ সক্রিয়তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে দেয়নি। তবে এমন বৃষ্টি থাকতে পারে শনিবার পর্যন্ত।
এদিকে সকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর বৃষ্টির জোর কিছুটা কমলেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক পানিতে ডুবেছে। ভোগান্তিতে পড়েন ঘরে ফেরা মানুষ। অনেক এলাকায় দোকানপাটে পানি ঢুকেছে। রাজধানীতে যানবাহনের চাপ ছিল কম। বাস, রিকশা, অটোরিকশা এবং রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক না থাকায় ঘরে ফেরা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। 
পথচারীদের অভিযোগ, বৃষ্টির কারণে রিকশা ভাড়া দ্বিগুণ-তিন গুণ চাওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।জলবদ্ধতা দেখা দিলে ১৬১০৬ অথবা কন্ট্রোল রুমে (০১৭৩৩৯৮২৪৮৬) তথ্য দিতে বলা হয়েছে। দ্রæত জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। উপকূলে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা রয়েছে।উপকূল পানির নিচে-স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নোয়াখালীর নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে নিঝুমদ্বীপসহ বেশ কিছু এলাকা। হাতিয়ার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ দু’দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দানু মিয়ার (৪০) মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুর ১টার দিকে কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। 
টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপে পাঁচ ফুট উঁচু জোয়ার আঘাত হেনেছে। অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। ঘাটে নোঙর করা পাঁচটি ট্রলার বিধ্বস্ত হয়েছে।বরগুনার পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল আমতলী-পুরাকাটা ও বরইতলা-বাইনচটকি ফেরি চলাচল। পায়রা নদীর পানিতে আমতলী ও তালতলীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের ২৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন দুই উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।
ভোলা-সংলগ্ন মেঘনার দৌলতখান ও তজুমদ্দিন, বিষখালীর ঝালকাঠি ও বরগুনার বেতাগী, পায়রার মীর্জাগঞ্জ, কচার উমেদপুর, বলেশ্বরের পিরোজপুর পয়েন্টে জোয়ারের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।ফলে নদনদী-সংলগ্ন চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ডুবে গেছে ইন্দুরকানীর একাংশ, কালাইয়া, সাউদখালী, বালিপাড়া, চরবলেশ্বর, চন্ডীপুর, খোলপেটুয়া ও কলারণ।সাতক্ষীরার আশাশুনিতে জোয়ারে রিং বাঁধ ভেঙে প্রায় ৪০০ বিঘার চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে। গত তিন দিনে ২০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ঘের মালিকরা জানিয়েছেন।অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষীপুরের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মেঘনা নদীর লক্ষীপুর-ভোলা-বরিশাল রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক স্থানে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে জোয়ারের পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। তলিয়ে যায় ঘরবাড়িসহ ফসলি জমি। বৃষ্টি ও জোয়ারে তলিয়ে গেছে পটুয়াখালী শহরের পুরাতন হাসপাতাল রোড, মহিলা কলেজ রোড, মুন্সেফপাড়া, জুবিলী স্কুল রোড ও লঞ্চঘাট।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও বৃষ্টির প্রভাবে বাগেরহাটের নদনদীর পানি বেড়েছে। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবেছে। শেলার চর থেকে নদীতে ভেসে যাওয়ার সময় হরিণশাবক উদ্ধার করেছেন বনরক্ষীরা। ভোলার তজুমদ্দিন ¯øুইসগেট এলাকার নির্মাণাধীন রিং বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে স্রোতের তোড়ে পাঁচটি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্থ। ভোলার সঙ্গে সব রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। চরফ্যাসনের চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের চর পাতিলার দুই গ্রাম ও বাঁধের বাইরে পাঁচ শতাধিক পুকুর ও খামারের মাছ, গবাদি পশু ভেসে গেছে। ধসে পড়েছে পাকা সড়ক।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় শঙ্খ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি।এতে তলিয়েছে কৃষিজমি ও মৎস্যঘের। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বৃষ্টি ও জোয়ারে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হাঁটুপানিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের কাঁচা রাস্ত ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে শতাধিক মৎস্য ঘের। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন।নৌ ও ফেরি চলাচল বন্ধ-নদী উত্তাল থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথে সব ধরনের যান চলাচল গতকাল থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ)। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ছয় জেলায় বন্যার আভাস-ভারী বৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ছয় জেলা– ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরির আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল এক বুলেটিনে জানায়, আগামী দু’দিন ফেনীর মুহুরী নদী-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বাড়তে পারে। আর মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। পরদিন এসব নদীর পানি কমে যাওয়ার আভাসও দিয়েছে পাউবো। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলই, খোয়াই ও সোমেশ্বরী নদীর পানি আগামী তিন দিন বাড়তে পারে এবং বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় নদী-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি রয়েছে।আজও সারাদিন সারাদেশে বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে।
 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!