মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ব্যাটারি চালিত রিকশার বৈধতা না থাকায় ভাগাভাগির চাঁদাবাজি

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: মে ২১, ২০২৪, ১০:২০ এএম

ব্যাটারি চালিত রিকশার বৈধতা না থাকায় ভাগাভাগির চাঁদাবাজি


রাজধানীসহ সারাদেশেই ব্যাটারি চালিত রিকশার বৈধতা না থাকার সুযোগে চাঁদা দিয়েই চালাতে হয় মালিক-চালকদের। সাথে সরকারী-বেসরকারি বিভিন্ন পেশার রোকজনের মন্তব্য হচ্ছে চড়াদামে বিদ্যুত কেনা ফ্রি ব্যবহার করছে ব্যাটারি চালিত রিকশাওয়ালারা। লাখ লাখ ব্যাটারী চার্জ হচ্ছে সরকারী বিদ্যুতে। তাদেও এই চোরাই লাইনে ব্যাটারী চার্জ করার কারণে দেশের প্রায় সব এলাকায বিদ্যুত সংকট হচ্ছে। অথচ এই বিদ্যুত আমাদেও চড়াদামে কেনা।
অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশায় ভরে যাচ্ছে নগরীর অলি-গলির প্রতিটি পথ-সড়ক। ফলে সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত প্যাডেল রিকশা চালানো প্রায় বন্ধ হয়েই যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে নগরীতে চলাচলের অনুমতি পাওয়ায় নগরীতে আগামী দিনগুলোতে শুধুই ব্যাটারি চালিত রিকশায় ভরে না যায়। খোজ নিয়ে জানা গেছে দিনে ৩০০ টাকা জমায় নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। কিন্তু আইন অনুযায়ী এই যান্ত্রিক যান রাজধানীর সড়কে চলতে মানা। তাই সব সময় ধরা পড়ার ভয়ে থাকে চালকরা। একবার ধরা পড়লেই পুলিশকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। পুলিশের এই চাদাবাজীর কারণে অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশা কমে না বাড়ে। পুলিশ মাঝেমধ্যে ধাওয়া দিয়ে ধওে, মাল দিলে ছেড়ে দেয় বললেন চালক রাসেল। তখন রেকার বিল নামে টাকা নেয়। এ থেকে বাঁচতে গ্যারেজ মালিকের মাধ্যমে স্থানীয় লাইনম্যানরা পুলিশের সাথে সমঝোতা করেন। মাসে দেড় হাজার টাকা করে মালিক দিচ্ছেন পুলিশকে।
শুধু মো রাসেল, সোহেল বাবু এসব চালক নন, রাজধানীসহ সারাদেশের ব্যাটারিচালিত রিকশার লাখো চালক রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও স্থানীয় পর্যায়ের লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে জীবিকার চাকা ঘোরাচ্ছেন। ব্যাটারিচালিত ‘বাংলা রিকশা’, ব্যাটারির বড় রিকশা, ইজিবাইকের বৈধতা না থাকার সুযোগ নিয়ে চাঁদাবাজি করছে পুলিশ ও নেতারা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলর এতে যুক্ত।
সরেজমিন মিরপুর,খিলগাও, রামপুরা, কমলাপুর, বাসাবো, মাদারটেক লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর হাজারীবাগ, বেরীবাধ, খিলগাওসহ নগরীর বিভিন্ন অলি-গলি এলাকা ঘুওে দেখা যায়, প্রতিটি ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইক ‘মান্থলি’ (মাসিক চাঁদা) দিয়ে হাতে লেখা নানারকম প্রতিবন্ধী কোটা তৈরী করে টোকেন কিনে সড়কে চলছে। বাংলা রিকশা, অর্থাৎ প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি বসানো গাড়িকে মাসে হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বড় রিকশার চাঁদা ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। ইজিবাইকের মান্থলি তিন হাজার টাকা। এতে বিভিন্নস্থানে দুঘর্টনাও ঘটছে। অনেকেই চিরতওে পঙ্গুও হয়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট কারের সাথে প্রতিদিনই কোন নাকোনো এলাকায় সংঘর্ষ হচ্ছেই।
ঢাকার সড়কে চলা ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইকের আইনি বৈধতা নেই। অটোরিকশাসহ ধীরগতির সব ধরনের যানবাহন ২২ জাতীয় মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ। গত বুধবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদনহীন এসব যান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা আসে।ব্্যাটারি চালিত রিকশার মালিক-শ্রমিক চালকরা আন্দোলনে নামলে ২০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন, বিকল্প কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা চলবে। টেলিভিশনে এ খবর দেখে উল্লাস করেন অবৈধ ব্যাটারি রিকশার মালিক-চালকরা। তারা বলেন, নিবন্ধন পেলে চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি মিলবে।
রিকশা ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, আইনি বৈধতা না থাকায় যে যেভাবে পারছে, চালকের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে। অথচ ধীরগতির এসব যানবাহনকে নিবন্ধন এবং চালককে লাইসেন্স দিলে বছরে সরকারের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। বেআইনি হয়ে চলতে চাই না। নিবন্ধন, লাইসেন্স দিলে চাঁদাবাজি অনেকটা কমবে। দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কেও চলতে চাই না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ মোটর তৈরি করে দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে গতিসীমা ২০-২৫ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব।
এদিকেযে কোনো জায়গায় ব্যাটারি রিকশার চাকা ঘুরলেই টাকা আসে। মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, সবুজবাগ, যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী এলাকায় হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। গ্যারেজ রয়েছে অর্ধশতাধিক। তবে যে কেউ রিকশা নামাতে পারবে না। এর আগে এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে নিতে হবে অনুমতি।
মুগদা, মান্ডা, মানিকনগরসহ আশপাশ এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের জন্য মালিকদের অনুমতি নিতে হয় মো. আলাউদ্দিন ও মো. নাসির নামের দুই ব্যক্তির কাছ থেকে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রকও রয়েছে। তারাও কার্ড বিক্রি করে রিকশা মালিকের কাছে। কাজলা এলাকার গ্যারেজের মালিক আনোয়ারও রিকশার অনুমতিপত্র বিক্রি করেন। অনুমতি বলতে লিখিত কিছু নয়, একটি কাগজের টোকেন দেওয়া হয়। এটিই অনুমতিপত্র। এ টোকেন রিকশায় সাঁটানো থাকলে সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার পুলিশ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। টোকেনের মেয়াদ এক মাস। প্রতি রিকশার এক মাসের টোকেন ফি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সংশ্লিষ্ট থানা ও ট্রাফিক পুলিশের কিছু কর্মকর্তাসহ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পান টোকেনের টাকার ভাগ।
খোজ নিয়ে আরও জানা গেছে কাজলার পাড় নতুন রাস্তা এলাকার ইয়াসিন হোসেন লিটন ‘হাতিমার্কা’ লাল কার্ড বিক্রি করেন। এ কার্ড লাগানো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে ধলপুর, কাজলা, বউবাজার, উত্তর যাত্রাবাড়ী, বিবিরবাগিচা এলাকায়। এ ছাড়া ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ রিকশা মালিক সমিতি’, ‘একতা সমবায় রিকশা মালিক সমিতি’র নামেও টোকেন দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে এসব কার্ড দেখা গেছে।
রিকশা থেকে এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজিও হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা আবদুল খালেক, ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হাবিব, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা হারুন অর রশিদ, নান্টু, শাহাদাত, মনির যাত্রাবাড়ীতে এলাকাভিত্তিক রিকশা থেকে চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কদমতলী এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার অন্যতম নিয়ন্ত্রক সাহাবুদ্দিন ও মীরহাজিরবাগ এলাকার দাদন। তবে দাদন সমকালকে বলেন, দুই মাস আগে আমি এসব কাজ ছেড়ে দিয়েছি। কাজলা, শনির আখড়া, বিবিরবাগিচাসহ আশপাশের এলাকার একাধিক রিকশাচালক সমকালকে জানান, নিয়মিত চাঁদা দেন। পুলিশ রাস্তায় রিকশা ধরলে নিয়ন্ত্রকের নাম বললে ছেড়ে দেয়। অনেক সময় কিছু পুলিশ সদস্য ছাড়তে চায় না। তখন বাড়তি টাকা দিতে হয়।
ব্যাটারি রিকশার অন্যতম নিয়ন্ত্রক মুগদা এলাকার আলাউদ্দিন নিজেকে জাতীয় শ্রমিক লীগের মুগদা থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে জানান, তিনি রিকশার কার্ড বিক্রি করেন না। নিজের গ্যারেজ ও ব্যাটারি রিকশা আছে। মানিকনগর থেকে রামপুরা পর্যন্ত ৩৫ গ্যারেজের পাঁচ শতাধিক রিকশা রয়েছে। প্রতিদিনই রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ রিকশা ধরে রেকার বিল করে। এসব বিল ৩৫ গ্যারেজ সমান ভাগে পরিশোধ করে। গত এপ্রিলে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা রেকার বিল এসেছে। এ টাকা কীভাবে তোলা হয়– এমন প্রশ্নে বলেন, গ্যারেজ মালিক নিজেরা দেন রিকশার জমা থেকে।
আফতাবনগর এলাকায় প্রায় ৩০০ ব্যাটারি রিকশা চলে। প্রায় প্রতিটি রিকশায় লাল কার্ড সাঁটানো। আফতাবনগরের রিকশা গ্যারেজের মালিক আলীর কাছ থেকে প্রতি মাসে এই কার্ড কিনতে হয়। কার্ডের ‘দাম’ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
রাজধানীর কুবুব, সাহাবুল মিয়াসহ একাধিক চালক উত্তর বাড্ডার জাহাঙ্গীর আলমের গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় নিয়ে রিকশা চালান। মালিক প্রতি মাসে রিকশার সঙ্গে একটি টোকেন সেঁটে দেন। টোকেন দেখলে পুলিশ আটকায় না। তবে মাঝেমধ্যে আটকে রেকার বিলের নামে ১ হাজার ২০০ টাকা নেয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর আলম একসময় বিএনপির রাজনীতি করলেও তিনি এখন স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছের লোক। এ এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ আছে ৬০-৭০টি। এসব রিকশার টোকেন আসে ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম গণির অফিস থেকে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাদের টোকেন কাউন্সিলরের লাইনম্যান থেকে নিতে হয়। এ টাকার ভাগ সবাই পান। এ বিষয়ে কাউন্সিলর মাসুম গণির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার, আজমপুর, খিলক্ষেত, আবদুল্লাহপুর, উত্তরখান ও দক্ষিণখান রুটভিত্তিক চলে এসব টোকেনের অটোরিকশা। আবদুল্লাহপুরে হাসান, শাহআলম, মিজান; আজমপুর রেললাইনে মোকলেস হেলাল, বিপ্লব; উত্তর ও দক্ষিণখানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফারুক, জামাল হাসান লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ১৫০ টাকা হারে এসব অটোরিকশার চাঁদা কাউন্সিলর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আর পুলিশের পকেটে যায়। এসব লাইনম্যানের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফারুক, জামাল হাসান ডিএনসিসির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতালেব মিয়ার লোক। মোতালেব মিয়া সমকালকে বলেন, অটোরিকশার চাঁদার বিষয়ে কিছু জানি না। তারা আমার রাজনীতি করে না।
রোববার ফার্মগেট এলাকায় ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছিলেন মোজাম্মেল (ছদ্মনাম)। তাঁর অটোরিকশার পেছনে ‘রিকশা সমবায় সমিতি, টিজি’ নামে গত আগস্ট থেকে চলতি মাসের জন্য আলাদা স্টিকার। তিনি জানান, তাঁর গ্যারেজের মালিক জামান মিয়া। তিনি ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামীম হাসানের লোক। তাঁর গ্যারেজে ৩০টি রিকশা আছে। মাসিক হাজার টাকা চাঁদায় ‘রিকশা সমবায় সমিতি, টিজি’ নামে চলে রিকশাগুলো। যানবাহন বিশেজ্ঞদের মতে রাজধানীতে যে হাওে এই অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশা বেড়ে যাচ্ছে তাতে আগামীতে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এতে একদিকে যেমন যানজট বাড়বে অন্যদিকে দুর্ঘটনাও পিছু ছাড়বেনা। মতলববাজরা ফায়দা লুটবে। বিদ্যুতের াবচয় দিনদিন বাড়বে।

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!