লুটেপুটে খেতে পিছিয়ে ছিলেন না উচ্চশিক্ষিত সাবেক আওয়ামী আমলারা। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন আট আমলা, এদেরকে বলা হতো আওযামী আমলা, ফায়দা লুটতে দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যববহার করাই ছিল তাদের কাজ,আর প্রশাসনেও করে রাখতেন নানারকম বিভাজনে। স্বৈরাচারের আশকারা পাওয়ায় তারা হয়ে ঊঠে বিড়ালের সিংহ। তাঁদের ছয়জনের নামেই দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন শেখ মো. ওয়াহিদ উজ জামান, আবুল কালাম আজাদ,কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী (কবি কামাল চৌধুরী),নজিবুর রহমান, ড. আহমদ কায়কাউস ও তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ওরফে রিপন মিয়া। দায়িত্বে থাকা ৮ মুখ্য সচিবের মধ্যে আবদুল করিম ও শেখ সোবহান শিকদারের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কোনো ধরনের অভিযোগ নেই দুদকে। আবদুল করিম ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল এবং শেখ সোবহান শিকদার ২০১৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মুখ্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময়কার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে রয়েছেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ও আবুল কালাম আজাদ।দুদক সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, শেখ হাসিনার মুখ্য সচিবদের মধ্যে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগে জড়ান জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদ উজ জামান। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। অভিযোগ, জনতা ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের একজন তিনি। অ্যানন টেক্স,ক্রিসেন্ট গ্রæপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ এবং খেলাপির ক্ষেত্রে অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওয়াহিদ উজ জামানের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে তাঁর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। তবে অনুসন্ধানটি টানা প্রায় ছয় বছর ফাইলবন্দী রাখা হয়। ২০২১ সালে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রায় পৌনে ছয় শ অভিযোগের পরিসমাপ্তি টানেন। এর মধ্যে ছিল ইকবাল মাহমুদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ওয়াহিদ উজ জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগও। পরে জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আবার তাঁর নাম এলে দুদক তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তাঁরা হলেন, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, আহমদ কায়কাউস, নজিবুর রহমান ও কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।দুদক সূত্রটি জানায়,শেখ হাসিনার সর্বশেষ মুখ্য সচিবের দায়িত্বে থাকা মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ওরফে রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে প্রকল্পে অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের একটি দল এর অনুসন্ধান করছে।
আহমদ কায়কাউসের বিরুদ্ধে অভিযোগ,তিনি বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতের আদানি গ্রæপের সঙ্গে অসম চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক ও কর অব্যাহতি প্রদান করে রাষ্ট্রের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি করেছেন। তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসচিব থাকা অবস্থায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে এসব চুক্তি করেছেন।
অন্য দিকে সারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যুরাল নির্মাণ এবং মুজিব শতবর্ষ পালনের নামে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা অপচয় ও আত্মসাতের একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এতে সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে আরেক মুখ্য সচিব এবং জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধেও।দুদকের মহাসচিব ও সংস্থাটির মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন সাবেক এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্ত বিষয়ে বলেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগগুলো এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হলে কর্মকর্তারা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।’দুদক সূত্র জানিয়েছে,এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের ছয়টি পৃথক দল কাজ করছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক। চাওয়া হয়েছে অভিযুক্তদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের (টিআইবি)নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ ও লুটপাটের সুযোগ, সুরক্ষা ও বিচারহীনতা যেভাবে দেশে কর্তৃত্ববাদের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে,এটা তারই উদাহরণ। মুখ্য সচিবের মতো উচ্চপর্যায়ের আমলাতান্ত্রিক অবস্থানে থেকে অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনৈতিক,আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক ক্ষমতার ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেটের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্পন্ন করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হলে এই সাবেক মুখ্য সচিবদের পাশাপাশি যাঁরা চোরতন্ত্রের অন্যান্য অংশীদার, সুবিধাভোগী ও সুরক্ষাকারী ছিলেন তাঁদেরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপকর্ম প্রতিরোধের জন্যও বার্তা প্রদান সম্ভব হবে। অভিযোগ আছে স্বৈরাচারের আমলে অবসরে থাকা সাবেক জন প্রশাসন সচিব ইকবালকে দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার পর সার্টিফিকেটের ব্যবসা করে তিনি বিপুল দুর্নীতি করেন।
আপনার মতামত লিখুন :