দেশের ছোট দরবেশখ্যাত ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি নাসা গ্রæপের কর্ণধার। এক্সিম ব্যাংক ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টাকা যোগান দাতা হিসেবেই দেশের মানুষ জানেন। প্রায় সময়েই বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকদের সাথে নিয়ে টাকা তুলে শেখ হাসিনার হাতে নানা রকম ফান্ডের নামে তুলে দিতেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা পুরো সময় বিএবির শীর্ষ পদে থেকে চালিয়েছেন লুট। ২২ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেওয়া অর্থ পাচার করেছেন বিভিন্ন দেশে। ওই টাকায় বিদেশে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান। ক্রয় করেছেন বাড়ি।কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একাধিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৩ ফেব্রæয়ারি আদালত নজরুল ইসলাম মজুমদার, তার স্ত্রী নাসরীন ইসলাম, মেয়ে আনিকা ইসলাম,ছেলে ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন। জানা গেছে নজরুল ইসলাম মজুমদার তিন পদ্ধতিতে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন। পদ্ধতিগুলো হলো আমদানি, রপ্তানি বাণিজ্য ও হুন্ডি। পাচার করা টাকায় তিনি বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। এছাড়া বিদেশে ১৮টি শেল কোম্পানি (বেনামি) গঠন করে সেখানে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। করেছেন মুনাফা। কিন্তু লাভের অর্থও দেশে আনেননি। এগুলোকে পাচার হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। পাচার করা অর্থে বিদেশে গড়া সম্পদের মধ্যে তিন দেশে ৮টি সম্পদ শনাক্ত করে এগুলো উদ্ধারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬২০ কোটি টাকা। এসব সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের কবজায় নেওয়া হয়েছে। পাচারের আরও সম্পদের সন্ধানে তদন্ত চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংকের বিদেশে দুটি এক্সচেঞ্জ হাউজ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরণের নামেও জালিয়াতি করে টাকা পাচার করেছেন। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।নাসা গ্রæপের টাকা পাচারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আরও জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এখন গ্রæপের জালিয়াতির ওপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক),জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডি পৃথকভাবে তদন্ত করছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, নাসা গ্রুপের জালিয়াতি করা অর্থে গড়া সম্পদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সরকারের কবজায় নেওয়া হয়েছে মোট ৬ হাজার ৯৫১ কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে দেশে থাকা সম্পদ রয়েছে ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকার এবং বিদেশে রয়েছে ৬২০ কোটি টাকার সম্পদ। এ সম্পদের মূল্য আগে ছিল ৬৭০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম কমায় সম্পদের মূল্যও কিছুটা কমেছে।
নাসা গ্রæপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামে রাজধানীর তেজগাঁও, গুলশান ও মহাখালী এলাকায় ৬টি বাড়ি শনাক্ত করা হয়েছে। দলিলমূলে এর মূল্য ১৮৪ কোটি টাকা। বাজারমূল্যে চার হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পূর্বাচলে প্লট আছে ৮টি। দলিলমূলে এগুলোর দাম দেড় কোটি টাকা। বাজারমূল্যে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই দুই খাতে সম্পদের মূল্য ৪ হাজার ৬৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বিদেশে ৬২০ কোটি টাকার সম্পদ শনাক্ত করে সেগুলো ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫টি যুক্তরাজ্যে। ইউরোপের দেশ ফান্সের নিটকবর্তী ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীনস্থ স্বায়ত্তশাসিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র জার্সি। এখানেও নাসা গ্রæপের একটি সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র আইল অব ম্যান। দেশটিতে নাসা গ্রুপের ২টি সম্পদের সন্ধান মিলেছে। দলিলমূলে এগুলোর দাম ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড বা স্থানীয় মুদ্রায় ৫ কোটি ৪ লাখ ডলার।আদালত কর্তৃক দেশীয় অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে ৮৯০ কোটি টাকার। আইল অব ম্যানের বার্কলে ব্যাংক পিএলসিতে ২ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডের বা স্থানীয় মুদ্রায় ৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকার স্থিতি পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তদন্তে নাসা গ্রæপের নামে যুক্তরাজ্য, হংকং, আইল অব ম্যান ও জার্সিতে মোট ১৮টি শেল কোম্পানি বা মালিকানার পরিচয় গোপন করে বেনামি কোম্পানি শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগের তথ্য এখন অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এসব কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি, রপ্তানি, হাউজিং ও ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।
বিদেশে নাসা গ্রæপের ওইসব সম্পদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ওইসব সম্পদের হস্তান্তর ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বা হস্তান্তরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া শনাক্ত করা তিন দেশের সম্পদের বিষয়ে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আদালত থেকে সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার রায়ের ওইসব কপি সংশ্লিষ্ট দেশের মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। যাতে পাচারকারী ওইসব সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তর করতে না পারে। তবে সম্পদ এখনো পাচারকারীই ব্যবহার করছেন।
এখন সরকার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট বা এমএলএআর পাঠানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনটি দেশে তিনটি এমএলএআর পাঠানো হবে। এগুলোর খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, আইল অব ম্যান ও জার্সির সঙ্গে চুক্তি হবে। এর আওতায় আরও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া দেশের আদালতে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর রায় হলে তা ওইসব দেশে পাঠিয়ে সেখানে সম্পদ উদ্ধারের মামলা করতে হবে। ওই মামলায় রায় বাংলাদেশের পক্ষে এলেই কেবল সম্পদের অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলো আগামী দুই বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আরও বেশি সময় লাগবে। এসব মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি করতে আইনি বাধ্যবাধকতা রেখে নতুন আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশে মামলা হলে সাধারণত দুই বছরের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
পাচার করা টাকা ফেরত আনতে হলে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে ওইসব অর্থ এ দেশ থেকে বেআইনিভাবে নেওয়া হয়েছে। জালজালিয়াতি বা কর ফাঁকি দিয়ে নিলে সেটি বাংলাদেশের পক্ষে আরও ইতিবাচক হবে। বিদেশে যেসব বাংলাদেশির সম্পদ শনাক্ত করা হয়েছে তার সবগুলোই জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ নিয়ে করা হয়েছে।
আদালতের আদেশের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৫২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবে স্থিতি হিসাবে রয়েছে ৫২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় ৫২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, দেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে ৩ হাজার ৮১ ডলার বা ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও ৬ হাজার ৬৪০ পাউন্ড বা ১০ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। ৫৫টি কোম্পানির ৩৬৯ কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার নামে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
নাসা গ্রুপ দেশ থেকে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে তিনটি মাধ্যম ব্যবহার করেছে। রপ্তানির মূল্য দেশে না এনে ওইসব অর্থ পাচার করেছে। ফলে আমদানিতে বেশি দাম দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। আবার খেজুর আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। খেজুরের বাড়তি মূল্য হুন্ডিতে বিদেশে পাঠিয়েছে। ফল আমদানির ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম মজুমদার তার জামাতার কোম্পানিকে ব্যবহার করেন। তবে নাসা গ্রæপের দেশ থেকে টাকা পাচারের এখনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি দেশ থেকে কমপক্ষে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :