এনআরবিসি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মেদ আদনান ইমাম নামে-বেনামে ১৩টি ব্যাংক থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এ যেনো শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা কিংবা বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া। আদনানেন নেওয়া ঋণের বেশির ভাগ টাকা পাচার করে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছেন তিনি। বর্তমানে অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যে।
এ টাকা উদ্ধারে ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতে মামলা করলেও ‘ব্যাংক গ্যারান্টি’ কম হওয়ায় সমুদয় অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। কারণ,ঋণের বিপরীতে জামানতের মূল্য যাচাই বাদে এবং চাপ প্রয়োগ করে এসব ঋণ গ্রহণ করা হয়।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়,আদনান ইমাম ১৩টি ব্যাংক থেকে নিজের নামে ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। অন্যদিকে কর্মচারীর নামে কোম্পানি খুলে ঋণ নিয়েছেন আরও ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। আওয়ামী সরকারের আমলে শুদ্ধাচারের বাইরে জামানতের মূল্য যাচাই বাদে এসব ঋণ অনুমোদন দেয় ব্যাংকগুলো।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আদনান চাতুরী করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গ্রামের বাড়ি পটিয়ায় নিজের এবং বাবার নামে থাকা বেশির ভাগ ভূসম্পত্তি বাংককে মর্টগেজ দেননি। অন্যদিকে তার কোম্পানির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিপুল পরিমাণ ঋণের গ্যারান্টার হিসাবে রাখেন। ঋণ আদায়ে তাদের নামেও মামলা করতে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
আদনানের দৃশ্যমান ঋণের মধ্যে রয়েছে-এনডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস (বিডি) লিমিটেডের নামে ইউসিবি ব্যাংক থেকে ৫৭০ কোটি (মামলা চলমান),এসআইবিএল থেকে ৮৯ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ২২ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি),সিটি ব্যাংক থেকে ১৩৫ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), ইউসিবি থেকে ৮৭ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি, মামলা চলমান),পদ্মা ব্যাংক থেকে ১৬ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), ওয়ান ব্যাংক থেকে ১৩ কোটি ৫০ লাখ (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ৭৭ লাখ (ইচ্ছাকৃত খেলাপি),ইউসিবি থেকে ৩৩৫ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি, মামলা চলমান), এবি ব্যাংক থেকে ৫৫ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), ওয়ান ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৩৫ লাখ (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), এক্সিম ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ৫৫ কোটি(ইচ্ছাকৃত খেলাপি),ইউসিবি থেকে ৫৮ কোটি (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), সিটি ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি টাকা (ইচ্ছাকৃত খেলাপি) ঋণ।
এছাড়া অদৃশ্য ঋণ বা বেনামি কাগুজে কোম্পানি বা অন্যের নামে কোম্পানি খুলেও ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। তার কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারীর নামে কোম্পানি খুলে এসব ঋণ গ্রহণ করেন তিনি। আইপিই গ্রæপের বেতনভুক্ত কর্মীর নামে ৫টি কোম্পানি খুলে ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকের চাপে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন সেই গ্রহীতারা।আদনানের এসব অদৃশ্য ঋণের মধ্যে রয়েছে-ইক্সোরা অ্যাপারেলস লিমিটেডের নামে এনআরবিসি থেকে ১২৬ কোটি, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের নামে ইউসিবি থেকে ২৩০ কোটি, টিএসএন ট্রেড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের নামে ইউসিবি থেকে ২৬২ কোটি ও এনআরবিসি থেকে ৫ কোটি, বাংলা-ইউকে অ্যাগ্রো প্রডাক্টস লিমিটেডের নামে ৩৮০ কোটি এবং ডায়মন্ডরিজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে ৩০ কোটি টাকা। অন্যের নামে নেওয়া সব ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি করেছেন তিনি।
এর বাইরে বেনামি কোম্পানি ফুলপুর অ্যাগ্রো লিমিটেডের নামে ইউসিবির কাওরান বাজার শাখা থেকে ঋণ নিয়ে দুটি গাড়ি কেনেন। ঋণের দায়ে ১৫ কোটি টাকা দামের একটি গাড়ি (চট্ট-মেট্রো-ভ-১১-১১১১) জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউসিবির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) মাইনুল কবির।
এদিকে ইক্সোরা অ্যাপারেলস লিমিটেডের নামে দুইজন কর্মী এবং এক পোশাক কারখানার মালিকের নামে গোপনে এনআরবিসি ব্যাংক উত্তরা শাখা থেকে ধাপে ধাপে ১২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন আদনান। গোপনে তাদের নামে কোম্পানি খুলে তাদের নামে ঋণ অনুমোদন করা হয়। তবে এই ঋণ সম্পর্কে গ্রহীতারা জানেন না এবং কোথাও তাদের স্বাক্ষর নাই বলে দাবি করেছেন।
খেলাপি এই ঋণ আদায়ে চতুর্থবারের মতো চিঠি পাঠিয়েছেন এনআরবিসি ব্যাংক উত্তরা শাখার প্রধান ব্যবস্থাপক গোলাম মোহম্মদ। তিনি বলেন,বকেয়া পরিশোধে কয়েকদিনের মধ্যে আইনজীবীর মাধ্যমে গ্রহীতাদের ৩০ দিনের সময় দিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করলে অর্থঋণ আদালতে মামলা করবে ব্যাংক।
এসব ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় আদনানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলা তদন্ত করতে সিআইডিকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। তবে এ মামলা ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী একজন আইনজীবীকে দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সিআইডির তদন্ত কার্যক্রম ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করেছে আদনানের অনুগতরা।
আরও জানা যায়, ঋণের বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। আদনান ইমামের আইপিই গ্রæপের প্রধান পাঁচ সহযোগীর মাধ্যমে অন্তত ৫টি দেশে এই টাকা পাচার করা হয়। আদনানের পরিবারের প্রত্যেকে বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় দুই দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন তারা। পাচারের টাকায় যুক্তরাজ্যে ৩৪টির বেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন আদনান, যার মূল্য একশ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের চেয়েও বেশি সম্পদ দুবাইয়ে অর্জন করেন তিনি। দেশটিতে প্রায় ৬শ থেকে ৭শ বিলিয়ন ডলারের ভিলা ও কটেজ স্ত্রীর নামে কিনেছেন আদনান। আমেরিকায়ও তার প্রচুর সম্পদ রয়েছে বলে একটি বিশেষ সূত্র নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে আদনান ঢাকার উত্তরা, গুলশান, চট্টগ্রামের খুলশী, পাহাড়তলী ও গ্রামের বাড়ি পটিয়ায়ও ভূসম্পদ কেনেন।আদনানের নিজের নামে ১৪৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ৯৬৩ কোটি টাকা নিয়েছেন। তার মধ্যে মোট ৯০৫ কোটি টাকা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ায় তিনটি মামলা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অর্থ পাচার মামলায় ইতোমধ্যে আদনানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট।মানি লন্ডারিংয়ের কারণে গত বছরের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তার সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে। দুদক তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আদনানের সঙ্গে স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমাম,বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম ও মা নিলুফার ইমামের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, গ্রহীতার অজান্তে ঋণ অনুমোদন করার বিষয়ে আমাদের বিশেষ টিম দেখছে এবং এ বিষয়ে লিখিত একটি অভিযোগ এসেছে। অর্থ পাচারের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক বড় অপরাধ হিসাবে গণ্য করে, এটি নিয়েও কাজ করছে।
দুদকের উপপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার আইনে আদালতের মাধ্যমে দুদক অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। দুদকের এটি চলমান ধারা, এটা অব্যাহত থাকবে।এনআরবিসি ব্যাংকে সদ্য যোগদানকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান যুগান্তরকে বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি এবং সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। তবে আপনার দেওয়া উত্তরা শাখার ঋণপত্রটি দেখে আমি অবগত হলাম। গ্রাহক সবার ঊর্ধ্বে,এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :