সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সম্পদের আমির খশরু,ঢাকায় ৩৬ ফ্ল্যাট,আছে একাধিক প্লটও

আইন-অপরাধ ডেস্ক

প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৫, ১২:০০ পিএম

সম্পদের আমির খশরু,ঢাকায় ৩৬ ফ্ল্যাট,আছে একাধিক প্লটও

উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিদর্শক কাজী আমীর খশরুর রাজধানীতে ৩৬টি ফ্ল্যাট। ধনে আমির নামও আমির। একজন চাকরিজীবীর এমন সম্পদ এ যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিল পতিত স্বৈরাচারের আমলে।রাজউক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, উপইমারত পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের সময় আমীর খশরুর বেতন স্কেল ছিল ১ হাজার ৪৮০ টাকা। মাসে মূল বেতন ছিল প্রায় চার হাজার টাকা। চাকরিজীবনের ৩২ বছরে নানা সময় নানা অভিযোগে এক যুগেরও বেশি সময় তিনি সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। বর্তমানে তাঁর বেতন প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
এই অবস্থায় রাজধানীতে আমীর খশরু ও তাঁর স্ত্রীর নামে ৩৬টি ফ্ল্যাট আছে। উত্তরায় ৩০ কোটি টাকা দামের দুটি প্লটও আছে। সব মিলিয়ে শতকোটি টাকার সম্পদ তাঁর। প্রাপ্ত অভিযোগ ও কাগজপত্র যাচাই কওে ও সরেজমিনে এসব তথ্যের সত্যতাও মিলেছে।
তার রয়েছে রাজধানীর বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১০ নম্বর রোডের ৭৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ছয়তলা বাড়ি। বাড়িটির নাম ফারিয়া নিশাত কুঞ্জ। প্রায় ৫ কাঠা আয়তনের কর্নার প্লটের বাড়িটির কাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। নিচতলায় পার্কিং, গার্ডরুম, একটি ফ্ল্যাট ছাড়াও অন্য তলাগুলোতে রয়েছে দুটি করে ১১টি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া। আমীর খশরু মাঝেমধ্যে সেখানে যান। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী মো. কালাম ও পার্শ্ববর্তী ভবনের বাসিন্দা জানান, এই বাড়ির মালিক আমীর খশরু, রাজউকে বড় চাকরি করেন। এ এলাকায় তাঁর আরও বাড়ি আছে বলেও জানান তারা।
সেই সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১১ নম্বর রোডের ৬৯ ও ৭১ নম্বর হোল্ডিংয়ে দুটি প্লটেরও মালিক এই রাজউক কর্মচারী। তিন কাঠা আয়তনের দুটি প্লটকে এক করে সেখানে ছয়তলা আরেকটি বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। বাড়িটিতে গাড়ি ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য রয়েছে দুটি বড় ফটক। প্রতিটি ফ্ল্যাটে রয়েছে তিনটি বেডরুম, তিনটি বারান্দা, ড্রইং-ডাইনিং, চারটি বাথরুম ও কিচেন কেবিনেট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন প্রায় দুই হাজার বর্গফুট। 
ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী ও একাধিক বাসিন্দা জানান, এ বাড়ির তিনটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন আমীর খশরু। তারা বলেন, একেকটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। ভবনের নিচতলায় পার্কিং, গার্ডরুম ও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ১১। 
আমীর খশরু বলেন, ‘এই দুটি প্লটের মালিক আমার স্ত্রী। যখন বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তখন ক্ষতিগ্রস্থদের কাছ থেকে আমি কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড (মালিকানাস্বত্ব) কিনে নিই। তখন একেকটি অ্যাওয়ার্ড ৪০-৫০ হাজার টাকায় কেনা যেত। পরে ডেভেলপারকে দিয়ে বাড়ি করি এবং অর্ধেক ফ্ল্যাট পাই।’ 
বাড্ডা পুনর্বাসন প্রকল্পের ১২ নম্বর রোডের ৬৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে তিন কাঠার ওপর আরেকটি ছয়তলার বাড়ির সঙ্গে আমীর খশরুর নাম জড়িয়ে আছে। এটিরও প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। তবে এই বাড়ির মালিকের নাম আসলাম বলে জানান বাড়ির একজন নিরাপত্তাকর্মী। আমীর খশরুর একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জানান, খশরুর ভাগনে এই আসলাম। বাড়িটির মূল মালিক তিনি নিজেই। বোন ও ভাগনের নামে এ বাড়ি করেছেন তিনি।এ বাড়ির বিষয়ে আমীর খশরু বলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজনের কার কী সম্পত্তি আছে, তা আমি জানি না।’
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৭৪১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৭টি ফ্ল্যাটের ছয়তলা বাড়ি রয়েছে আমীর খশরুর। এটি তাঁর প্রথম করা বাড়ি। আনুমানিক পাঁচ কাঠার ওপর গোলাপি, লাল ও আকাশি রং করা বাড়িটিতে একসময় তিনি নিজেই থাকতেন। বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, বাড়ির মালিক খশরু তেমন একটা আসেন না। তবে একটি ফ্ল্যাটে তাঁর এক আত্মীয় থাকেন। আর ভাড়া তুলে মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 
কাজী আমীর খশরু বলেন, পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাড়িটিই কেবল তাঁর নামে। তাঁর মা পৈতৃক সূত্রে সেখানে এক কাঠা জমি পেয়েছিলেন। আরও কয়েক কাঠা কিনে পারিবারিকভাবে বাড়িটি তিনি তৈরি করেছেন।
উত্তরায় দুই প্লট-উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ২২/এ নম্বর হোল্ডিংয়ে আমীর খশরুর রয়েছে পাঁচ কাঠার একটি প্লট। গত ৩০ এপ্রিল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে টিনশেড বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সামনে তিনটি দোকান। 
পোশাক দোকানি অজন্তা সেলাইঘরের স্বত্বাধিকারী আবদুস সালাম সমকালকে নিশ্চিত করেন, কাজী আমীর খশরু নামে রাজউকের এক ‘কর্মকর্তা’র কাছ থেকেই দোকান ভাড়া নিয়েছেন। তিনি জানান, দোকানগুলো ছাড়াও পেছনে আরও কিছু ভাড়াটিয়া আছেন। সব মিলিয়ে মাসে লাখ টাকার মতো ভাড়া ওঠে। মাস শেষে খশরু নিজে এসে ভাড়া নিয়ে যান। স্থানীয়রা জানান, প্লটটির বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর প্লটের মালিকও এই আমীর খশরু। কর্নারের এই প্লটটিতেও কিছু দোকানপাট বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোকানগুলো থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া পান তিনি।একটি দোকানের মালিক নিশ্চিত করেন,এটিও আমীর খশরুর। তিনি জানান, মাস শেষে প্লটের মালিক ভাড়া নিয়ে যান। স্থানীয়রা জানান, এই প্লটটির বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোটায় পূর্বাচলে আরেকটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন আমীর খশরু। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগে বরখাস্ত থাকার কারণে রাজউক তাঁকে প্লটের আইডি দেয়নি। এ প্লটের বিষয়ে আমীর খশরু বলেন, ‘একটি প্লট আমার মায়ের নামে।’ ভাড়াটিয়ারা বলছেন, অন্য প্লটটিও আপনার। আপনি ভাড়া তোলেন। এর জবাবে তিনি কিছু বলেননি। 
রাজউকে একচেটিয়া প্রভাব-বিভিন্ন প্লটের ফাইল আটকে রেখে বাণিজ্য করার অভিযোগে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হন আমীর খশরু। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর নামে একটি মামলা করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই মামলা থেকে দায়মুক্তি পান তিনি। তখন তাঁর আইনজীবী ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। আমীর খশরু এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পরে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে খশরুর বিরুদ্ধে দুদক ফের মামলা করে। এবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাজউক। বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আছে।
১৯৯৩ সালে রাজউকে চাকরিতে যোগদানের পর থেকে রাজউকের বিএনপিপন্থি শ্রমিক ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। একসময় ইউনিয়নের সভাপতিও হন। ওই সময় রাজউকে ছিল তাঁর একচেটিয়া প্রভাব। গত ৬ আগস্ট দলবল নিয়ে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানকে চাপ দিয়ে ইন্সপেক্টর পদ নেওয়ার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে রাজউক এখনও তাঁকে কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় পদায়ন করেনি।
এর পর রাজউকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে গত অক্টোবরে তাঁকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়। তিন মাস পর আমীর খশরু আবার রাজউকে বদলি হয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ভুল বুঝতে পেরে আবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেভাবেই তিনি ব্যাখ্যা করুন না কেন, রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হয়েও বৈধ আয়ে এত সম্পত্তির মালিক হওয়া সম্ভব না। এটা খুবই সোজাসাপ্টা ব্যাপার, রাজউকে অনিয়ম-দুর্নীতি আছে। তার ওপর তিনি রাজউকে শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় তিনি এসব সম্পত্তির মালিক হয়েছেন,বোঝাই যায়। রাজউকের উচিত হবে, এটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা না হলে দুর্নীতির অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারব না।’ খশরু বলেন ‘আমি চাকরিজীবনে কারও ক্ষতি করিনি। বিভিন্ন সাংবাদিকের উপকার করেছি। বিভিন্ন সময় তিনজন সাংবাদিক আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আল্লার কী খেল, তিনজনই অকালে মারা গেছেন। তবে খোজ নিয়ে জানা গেছে ওই ৩ সাংবাদিক বেঁেচ আছেন।’সুত্র-সমকাল

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!