জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীর।তিনি ২৪ গণঅভুখ্যানের শহীদ ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ শুকানোর আগেই নিজের আখের ঘুছাতে ব্যস্থ সময় পার করেন। এই তানভীর চক্রের বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি শুধু এনসিটিবিই নয়,সচিবালয়ে বিভিন্ন বদলির তদবিরেও ছড়ি ঘোরাতেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার জন্য কাগজ কেনায় মহালুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তাতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ডিসি নিয়োগে অবৈধ হন্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতে তাঁর চক্রের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে।অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব পদে থেকে তানভীরকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর অনিয়মের বিৃেদ্ধে অনুসন্ধানও শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।সূত্র জানায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের পরিমার্জন করতে গিয়ে বড় ধরনের সময়ক্ষেপণ হয়। মূলত গত ডিসেম্বরে বই ছাপার কাজ শুরু হয়। এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বই ছাপার কাগজের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগে থেকেই এনসিটিবিতে জেঁকে বসেন গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। তিনি এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে নতুন ফন্দি আঁটেন।কয়েকজন আমদানিকারককে দিয়ে কয়েক হাজার টন কাগজ আমদানি করান। দ্রæত বইয়ের কাজ শেষ করার দোহাই দিয়ে সেই আমদানির শুল্কও মাফ করিয়ে নেন। প্রেস মালিকদের জোর করে সেই কাগজ কিনতে বাধ্য করান। গত ১৮ ফেব্রæয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া চিঠিতে আমদানিতে ৫৩ শতাংশ শুল্ককর থাকায় তা মওকুফের অনুরোধ জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, শুল্ককর থাকলে কাগজের দাম বহুগুণে বেড়ে যাবে।
প্রতি টন কাগজের ইনভয়েস মূল্য ৬০০ ডলার। এর সঙ্গে শুল্ককর বাবদ ৫৩ শতাংশ যুক্ত হলে প্রতি টনের মূল্য দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৭৯৬ টাকা। ফলে মুদ্রণ ও বিতরণে দেরির সম্ভাবনা আছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চীন থেকে সাত হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন মুদ্রণ কাগজ আমদানির চুক্তি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তিতাস ট্রেডার্সসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই কাগজ আমদানি করবে বলে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, চলতি শিক্ষাবর্ষের পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সময় লাগায় অন্যান্য বছরের তুলনায় মুদ্রণ শুরু করতে দেরি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রণ শেষ করার প্রয়োজনীয়তা থাকায় স্থানীয় মিলে উৎপাদিত কাগজ দিয়ে চাহিদা পূরণ সম্ভব ছিল না। সূত্র জানায়, চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর শুল্ককর মওকুফ করে। স্বাভাবিকভাবে শুল্ককর মওকুফের টাকা বাদ দিয়ে প্রেস মালিকদের কাছে কাগজ বিক্রির কথা। কিন্তু আমদানি করা কাগজ বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হয় প্রেস মালিকদের। নাম প্রকাশ না করে একজন প্রেস মালিক বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে আমদানি করা প্রতি টন কাগজ এক লাখ ৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। অথচ যে মানের কাগজ তার বাজারমূল্য ছিল তখন এক লাখ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শুল্ককর মওকুফ করলে তা ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় আমাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা ঠিকই শুল্ক মওকুফ করিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে বেশি দর নিয়েছে। ফলে প্রতি টনে ৫০ হাজার টাকা করে বেশি নিয়েছে গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের চক্র। সেই হিসাবে আমদানি করা কাগজ থেকেই প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই সিন্ডিকেট। এরপর আবার দেশীয় কাগজ কেনার ক্ষেত্রেও আমাদের প্রেস ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেও কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে ওরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,গত নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত অলিখিতভাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাজই করেছেন তানভীর। তাঁর কথা না শুনলে সিনিয়র অনেক প্রেস মালিককে অপমান অপদস্থ করেন।গত ১০ মার্চ গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ডিসি নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্র সমন্বয়কের নাম এসেছিল গাজী সালাউদ্দিন তানভীর ওরফে তানভীর আহমেদের। এনসিটিবির বিতর্কে তাঁর নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। চলতি বছরে এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপানোর কাগজের বাজারদরের চেয়ে টনপ্রতি ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজ না কিনলে বই ছাপার ছাড়পত্র মেলেনি। এভাবে শুধু কাগজ থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছে এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তাসহ গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরের বিরুদ্ধে।’তানভীর প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘তাঁর নাম তানভীর, দেখলে মনে হয় আল্লাহ-রাসুলের প্রেরিত পুরুষ; সে ৪০০ কোটি টাকা মেরে দিছে। আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। আমি চার কোটি টাকা জীবনে দেখিনি।’জানা যায়,বগুড়ায় নিজের হাজার হাজার ফেস্টুন লাগিয়েছেন তানভীর। এ ছাড়া ব্যানার ও বিলবোর্ডেও নিজের প্রচারণা চালিয়েছেন। স্থানীয় পত্রিকায়ও বড় আকারে নিজের প্রচারণা চালিয়েছেন। ইফতার মাহফিল এবং ঈদ সালামি বাবদ লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি একটি বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন।
এনসিপি থেকে সাময়িক অব্যহতি-জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত ২১ এপ্রিল রাতে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত চিঠিতে তানভীরকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়।চিঠিতে বলা হয়, ‘জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আপনার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে এসেছে।’
দুদকের জালে সালাউদ্দিন তানভীর-এনসিপির বহিষ্কৃত নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। গত ৪ মে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দুদকের সামনে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ। দুদক গোয়েন্দা অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের দুর্নীতির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। সপ্তাহের ব্যবধানে এবার তাঁদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। সূত্র জানায়, সচিবালয়ে প্রবেশের নির্ধারিত অনুমতিপত্র বা পাস থাকার কথা নয় সালাউদ্দিন তানভীরের। তবে অভ্যুত্থানের প্রভাব খাটিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশের পাস হাতিয়ে নেন তিনি। এরপর নিয়মিত সচিবালয়ে গিয়ে ‘তদবির বাণিজ্য’ করতেন।
যা বললেন সালাউদ্দিন তানভীর-এনসিটিবির ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে গাজী সালাউদ্দিন তানভীর গত ১৩ মার্চ কোর্ট রিপোর্টার্স ইউনিটির (সিআরইউ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যদি এক পয়সা লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, আমি নিজের ইচ্ছায় এনসিপি থেকে পদত্যাগ করব।’সম্মেলনে গাজী সালাউদ্দিন তানভীর বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। সব কিছু সাচিবিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে। তিলকে তাল বানানো হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার কাগজ কেনা হয়েছে। অথচ বলা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। এটা হাস্যকর।সম্প্রতি একটি টেলিভিশনের টক শোতে উপস্থাপকের প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন তানভীর বলেন, ‘ডিসি নিয়োগে তিন কোটি টাকার চেক পাওয়ার সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আমি ওই ঘটনার পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম।’সংগৃহীত
আপনার মতামত লিখুন :