সোমবার, ০৬ অক্টোবর, ২০২৫, ২০ আশ্বিন ১৪৩২

ইয়াবার থাবা মুক্ত হলো না দেশ, বেড়ায় খেত খাচ্ছে

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ১১:২৩ এএম

ইয়াবার থাবা মুক্ত হলো না দেশ, বেড়ায় খেত খাচ্ছে

দেশের পর্যটন জেলা কক্সবাজার হয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা বড়ি দেশের অলিগলিতে পৌছে যাচ্ছে।মিয়ানমার থেকে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে চোরাপথে এসে এসব ইয়াবা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঢুকছে। অভিযোগ আছে এতে মিয়ানমারের সিন্ডিকেট, স্থানীয় চক্র ও রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাদক আসছে। প্রশাসন কঠোর নজরদারির কথা বলা হলেও বাস্তবে ইয়াবার স্রোত থামছে না।বেড়ায় খেত খেয়ে সাবার করছে। বরং বলা হচ্ছে, মাদক পাচার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন সুত্রের সাথে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ পুলিশ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে মাদক পাচারকারীদের সম্পৃক্ততা সর্বনাশা মাদককে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ করে তুলেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বয়ং মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি এ সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘মাদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গডফাদাররা চা-কফি খাচ্ছে।’
কক্সবাজারের অন্তত ২১টি সীমান্ত পথ দিয়ে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ মাদক দেশে ঢুকছে। স্থানীয়রা মিয়ানমার বা বার্মা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলে এসব চালান সরবরাহ করছে। মিয়ানমারের সিন্ডিকেট সীমান্ত পার করে কক্সবাজার থেকে অনায়াসে চট্টগ্রাম হয়ে খোদ রাজধানী ঢাকার অলিগলি পর্যন্ত চালান পৌঁছে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থারই কিছু অসাধু কর্মকর্তা। মাঝেমধ্যে মাদকের কিছু চালান অন্য বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও পুরো চক্র অক্ষতই থেকে যায়। আটক হয় মূলত চালান বা সাধারণ বাহকেরা।
আত্মসমর্পণ করা এক সময়ের শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার বলেন, ‘কী পরিমাণ ইয়াবা আর আইস টেকনাফ দিয়ে ঢুকছে, সেটা আপনাদের কল্পনার বাইরে। মাঝখানে কিছুটা কমেছিল। তবে এখন পাচার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মিয়ানমারের পার্টি এখন শহর পর্যন্ত চালান পৌঁছে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব ঠেকাতে পারছে না। ২০টি চালান গেলে সর্বোচ্চ একটা ধরা পড়ে। অনেক সময় সেটাও হয় সমঝোতা না হওয়ার কারণে।’
এদিকে জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি) বলছে, বাংলাদেশে প্রবেশ করা মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে, বাকি ৯০ শতাংশ অদৃশ্য থেকে বাজারে ছড়িয়ে যায়।
মাদকের কারবার থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের লাভবান হওয়ার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ইয়াবার চালান জব্দ করে টাকার ভাগাভাগিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে ১০ কোটি টাকার আটক ইয়াবা বিক্রি করে অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক ওসি জাহাঙ্গীর আলমসহ সাতজন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তাঁদের পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। গত বছরের আগস্টে রামুতে ৭০ হাজার ইয়াবাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিদর্শক আমজাদ হোসাইন। তিনি টেকনাফ অফিসে চাকরির সময় ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং নিজেই চালান বহন করে দিতেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে অধিদপ্তরের ভেতরে থাকা সিন্ডিকেটের তথ্য জানা যায়।
মাদক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা কক্সবাজারে দীর্ঘদিনের পদায়নকে কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত হলেও তাঁকে সরানো হয়নি।
দেশের অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে,প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া মাদক কারবারিদের এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোগসাজশ থাকায় এটি দিন দিন আরও সহজ হচ্ছে।
২০১৮ সালের মে মাসে র‌্যাব দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল। পরে পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও মাঠে নামে। মাদক ঠেকানোর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বহু লোক নিহত হলেও কাঙ্খিত ফল আসেনি। টানা ক্রসফায়ারের মুখে ২০১৯ সালে টেকনাফে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু কিছুতেই মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম থামেনি। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, অন্তর্র্বতী সরকার এসে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ১৫ সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযানের ফলও বলছে, ইয়াবা প্রবাহের গতি কমেনি।
গত ১৪ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৭ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা। শুধু এক দিনেই নাফ নদী থেকে ধরা পড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা। কখনো মাটির নিচে, কখনো মাছ ধরার ট্রলার আবার কখনো বসতবাড়ি থেকে ইয়াবার চালান পাওয়া যাচ্ছে।
‘মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস ২০২৫’-এ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বীকার করেন, ‘মাদককে এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। শুধু বহনকারীরা ধরা পড়ে, গডফাদাররা অদৃশ্য থেকে যায়। তারা বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় মাদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে চা-কফি খাচ্ছে।’ গডফাদারদের ধরতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন,‘প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় মাদক নিয়ে আলোচনা হয়। আমরা যেকোনো মূল্যে মাদকের গতি কমাতে চাই। দেশকে মাদকমুক্ত করা এখন চ্যালেঞ্জ।’সাম্প্রতিক অভিযান ও উদ্ধার হওয়া চালানের পরিমাণই বলছে, ইয়াবাসহ মাদকের স্রোতের সামনে প্রশাসন এখনো কার্যত অসহায়। 
মাদক বিরোধী সংগঠনগুলো মনে করেন যেদিন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে মাদক পাচারের গডফাদারদের সঙ্গে সখ্য কমবে, সেদিন থেকেই ইয়াবার প্রবাহ কমতে শুরু করবে। আগে আইনশৃংখলা বাহিনীগুলোর ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানো দরকার। এছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা লোকগুলো মাদকমুক্ত হতে হবে। বেড়ায় খেত খাওয়া বন্ধ করতে না পারলে মাদক আসক্ত সমাজ-দেশ গঠন করা সম্ভব হবে না।ছবি-সংগৃহীত

 

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!