রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

মুরাদের গ্রাসে নিঃস্ব প্রায় ৩টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৫, ০৬:৪৩ পিএম

মুরাদের গ্রাসে নিঃস্ব প্রায় ৩টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি

আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ছিল ফ্যাসিবাদ সরকারের ক্ষমতার চরম অপব্যবহারকারী ও দখলবাজদের মধ্যে অন্যতম সেরা একজন। তার কড়াল গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি ৩টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে মুরাদ দখলে নিয়ে নিয়েছিলেন ডিজনি ডিজাইন অ্যান্ড ডেভালপারস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। বাকি দুটি কোম্পানি হচ্ছে দারুল মাকান হাউজিং লিমিটেড ও দারুল ইসলাম হাউজিং লিমিটেড। তিনটি কোম্পানির প্রকৃত ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মো. শাহজাহান কোম্পানির শেয়ার হারিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমার ফাঁদে পড়ে বর্তমানে নিঃস্ব প্রায়। কোম্পানি বাঁচাতে ও গ্রাহকের আস্থা রক্ষার তাগিদে নিজের ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদের সিংহভাগ মর্টগেজ রেখে কোনোমতে টিকে আছেন তিনি। তবে এবার আশার আলো দেখছেন মুরাদ গ্রেপ্তার হওয়ায়। সম্প্রতি ঢাকায় ঝটিকা মিছিল করে গ্রেপ্তার হয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একাধিক হত্যা মামলার আসামী শাহে আলম মুরাদ।
জানা গেছে, ডিজনি ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডে ২০১৫ সালে ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. শাহজাহানের শেয়ারসহ আরো ৫ জনের শেয়ার জয়েন্ট স্টকে শূন্য করে ভুয়া রেজুলেশনের মাধ্যমে মুরাদ নিজেকে ওই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঘোষণা করেন। বাকি দুটি কোম্পানিকে (দারুল মাকান হাউজিং ও দায়ল ইসলাম হাউজিং লিমিটেড) জয়েন্ট স্টকে একইভাবে দখল করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় মুরাদ তার অনুসারীদের নিয়ে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ এবং গ্রাহকদের চাপ দিয়ে আদালতে মাইনরিটি শেয়ার অ্যাক্ট
ব্যবহার করে ২০১৮ সালে দুটি কোম্পানি ম্যাটার মামলা করেন, যার নাম্বার ২৫৮ এবং ২৫৯। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহজাহানের শেয়ার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে নিজের নামে নিয়ে নেন শাহে আলম মুরাদ। ২০১৫ সালের জুনে একটি ভুয়া রেজু্লশেন তৈরি করে নিজেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঘোষণা করেন মুরাদ।
মো. শাহজাহান অভিযোগ করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুরাদ প্রতিনিয়ত কোম্পানিগুলো তার কাছে হ্যান্ডওভার করার জন্য চাপ দিতেন। এক দিন তাকে পান্থপথের অফিসে আটকে রেখে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করলে সেদিন তিনি মোবাইল, মানিব্যাগ এবং ব্যক্তিগত ডায়েরি ফেলেই কোনোরকম পালিয়ে আসেন।
শাহজাহান বলেন,গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুরাদ ও তার অনুসারী কয়েকজন ডিরেক্টর মিলে কোম্পানি কব্জায় নিতে কোম্পানি ম্যাটার মামলাসহ নানা ইনজাংশন, স্টে অর্ডার, অর্ডার মডিফাইডের মাধ্যমে আইনের অপব্যবহার করে নাজেহাল অবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। এ কাজে তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন। এ কারণে একের পর এক মিথ্যা মামলা, প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে হেনস্তা হলেও জামিন নেওয়ার জন্য আদালতে হাজির হতেও রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন শাহজাহান। এমনকি শাহজাহানকে ফাঁসানোর জন্য ২০১৮ সালে সিআইডির এসআই অলক চন্দ্র হালদারকে দিয়ে হাজারিবাগ থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাও করা হয়েছিল শাহজাহান ও তার ছেলের বিরুদ্ধে। অথচ শাহজাহানের বিদেশে কোনো ধরনের ব্যাংক একাউন্ট বা সম্পদ নেই বলে প্রমাণ রয়েছে।
এদিকে শাহে আলম মুরাদ গ্রেপ্তার হলেও তার সাবেক সহযোগী মো. মোস্তফা নিজেকে বর্তমানে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন। মোস্তফা নিজেকে বর্তমানে বিএনপির বাড্ডা থানার নেতা দাবি করলেও আওয়ামী লীগ আমলে শাহে আলম মুরাদের ছত্রছায়ায় থেকে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্বঘোষিত বিএনপি নেতা মোস্তফা এরই মধ্যে কোম্পানির একটি প্রকল্প ‍‍`মাকান মডেল টাউন‍‍` পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন। সেখানে কোম্পানির কর্মচারী বা শেয়ার হোল্ডারদের কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছেন না।
এ বিষয়ে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নুর হোসাইনের ছেলে বর্তমানে ডিরেক্টর মাহির হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহজাহান স্যারের নির্দেশে প্রজেক্ট ভিজিট করতে গেলে মোস্তফা ও তার লোকজন আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং হাত-পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত নায়েম হোসাইন টিপু এবং সানি আরাফ নামে দুজন কর্মচারী জানান, মোস্তফা সাহেব এক সময় লুঙ্গি পরে এ প্রজেক্টের জায়গা বিক্রির দালালি করতে মাকান অফিসে যাতায়াত করতেন। কিন্তু কীভাবে তিনি দালাল থেকে মালিক হয়ে গেলেন, সেটি আমাদের বোধগম্যতার বাইরে।
জয়নাল আবেদিন নামে স্থানীয় এক মুরুব্বি জানান, মোস্তফা তো কোটিপতি হইছে শাহজাহান মিয়ার টাকায়। এখন তো সে বহু টাকা পয়সার মালিক। তিনি বলেন, মোস্তফা এর-ওর জায়গা দখল, ভেজাল করে জায়গার ওয়ারিশ কিনে হাউজিংয়ের ভেজাল জাযগা দিয়ে ডিরেক্টর হইছে।গাপন সূত্রে জানা গেছে, নামমাত্র জায়গা দিয়ে কোম্পানির শেয়ারের অংশীদার হয়ে রীতিমতো কোম্পানির মালিক দাবি করা মোস্তফা বর্তমানে কোম্পানি দুটিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য কয়েকজন গ্রাহককে মামলা করতে প্ররোচণা দিয়ে যাচ্ছেন। 
সরেজমিন দেখা গেছে, ২০১৩ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের উচ্চমাত্রার লভ্যাংশ প্রদানসহ ৩টি প্রকল্প মিলিয়ে ৭৩২টি প্লট হস্তান্তর করেছেন শাহজাহান। বাকি আছে প্রায় ১২৫টি প্লটের রেজিস্ট্রেশন। তবে কোম্পানি ম্যাটার মামলায় পিটিশনার হওয়ার কারণে আদালতের রায় অনুযায়ী, গ্রাহকদের প্লট রেজিস্ট্রেশন দিতে হলে মোস্তফার স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহজাহানকে বøাকমেইলের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। যদিও কোম্পানির কাছে বিক্রি করা তার ৭০ শতাংশ জায়গার কাগজ সঠিক না হওয়ায় এবং মোস্তফা ও তার দোসর কয়েকজন পরিচালককে এরই মধ্যে রেজুলেশনের মাধ্যমে বহিষ্কার করেছে কোম্পানিটি। মোস্তাফার সহযোগী হিসেবে আছেন বেলাল হোসেন, বিলাল, আজাহার, নূরুল আফসার, পারুল আক্তার। বর্তমানে মোস্তফার বিরুদ্ধে একাধিক দেওয়ানী মামলা আদালতে চলমান।
ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, শাহে আলম মুরাদের হস্তক্ষেপে প্রায় হারাতে বসা কোম্পানিকে আপনগতিতে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন শাহজাহান।মা. শাহজাহান বলেন, শাহে আলম মুরাদ ও মোস্তফা গং মিলে একটি সাজানো গুছানো কোম্পানিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন,তাদের কারণে প্রতারিত হয়েছেন অনেক গ্রাহক এবং বিনিয়োগকারী। এ বিষয়ে মামলা চলমান আছে। মামলা পুনরায় শুনানির জন্য আদালতে আবেদন করা হয়ছে। ভবিষ্যতে এ ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রতারণা থেকে গ্রাহক যেন রক্ষা পায়, প্রশাসনকে সেই দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ সংশ্লিষ্ট সকলের।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!