এই সমস্যাটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ধরা পড়ে।গত মাসে আইইএলটিএস ভুল ফল পাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঠিক ফলাফল জানায় এবং “আন্তরিক দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তা” প্রদান করে।
ক্রয়োডনের লুনার হাউসে অবস্থিত যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভিসা এবং অভিবাসন অফিস। হাজার হাজার অভিবাসীকে (মাইগ্র্যান্ট) বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও ভিসা দেওয়া হতে পারে। কারণ পরীক্ষার ফলাফল মার্কিংয়ে একটি বড় ভুল হয়েছিল। দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত একটি ভাষা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রায় ৮০ হাজার জনের ফলাফল ভুল এসেছিল। এর মানে হলো, তাদের মধ্যে অনেকেই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও তাদের পাস নম্বর দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে পরীক্ষায় জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।এই দেশগুলোতে অপরাধীরা অভিবাসীদের (মাইগ্র্যান্ট) কাছে পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করে, যাতে তারা আগে থেকেই উত্তর জানতে পারে।এর ফলস্বরূপ,ইংরেজি ভাষায় দুর্বল ছাত্র,এনএইচএস কর্মী এবং অন্যান্য অভিবাসীদের স্টাডি ভিসা বা কাজের ভিসা দেওয়া হয়েছে, যা পাওয়ার যোগ্যতা তাদের ছিল না।কনজারভেটিভরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে যারা এই পরীক্ষায় পাস না করেই ব্রিটেনে এসেছেন, তাদের প্রত্যেককে যেন দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
বিশ্বব্যাপী প্রতিত বছর প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম (আইইএলটিএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এই পরীক্ষার যৌথ মালিকানায় রয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট এবং শিক্ষামূলক সংস্থা আইডিপি।
২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে, হাজার হাজার মানুষ পরীক্ষায় ভুল স্কোর পেয়েছিলেন। আইইএলটিএস এর জন্য"একটি কারিগরি ত্রুটিকে" দায়ী করেছে,যা "কিছু আইইএলটিএস একাডেমিক এবং জেনারেল ট্রেনিং পরীক্ষার লিসেনিং এবং রিডিং অংশে সামান্য উপাদানের উপর প্রভাব ফেলেছিল।"
সংস্থাটি জানিয়েছে, পরীক্ষার মাত্র প্রায় এক শতাংশ এতে প্রভাবিত হয়েছিল। তবে এই সংখ্যাটিও প্রায় ৭৮ হাজার পরীক্ষার সমতুল্য হবে। এই সমস্যাটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ধরা পড়ে।গত মাসে আইইএলটিএস ভুল ফল পাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঠিক ফলাফল জানায় এবং "আন্তরিক দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তা"প্রদান করে। ধারণা করা হচ্ছে, কারও কারও নম্বর বাস্তবের চেয়ে বেশি হয়েছে, আবার কারও নম্বর কম দেখানো হয়েছে।
সমস্যাটি এত দেরিতে শনাক্ত হওয়ায়, যাদের ভুলভাবে পাস দেখানো হয়েছিল তাদের অনেকেই সেই ভুল ফল ব্যবহার করে ভিসা পেতে এবং আইনগতভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে।
গত বছর ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন জানায়, বিদেশি শিক্ষার্থীরা বেশি টিউশন ফি দেওয়ায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দুর্বল ইংরেজি দক্ষতাকে উপেক্ষা করছে। একই সঙ্গে কিছু লেকচারার অভিযোগ করেছেন যে বিদেশি শিক্ষার্থীদেও প্রায় ৭০ শতাংশেরই ইংরেজি জ্ঞানের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই। ঝুঁকিতে এনএইচএস রোগীরা-করোনার বা তদন্তকারী কর্মকর্তারাও সতর্ক করেছেন যে এনএইচএস এবং সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত বহু মানুষের ইংরেজি জ্ঞান অপর্যাপ্ত, যা রোগীদের ঝুঁকিতে ফেলছে এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
একটি ঘটনায় দেখা যায়, এক কেয়ার কর্মী কখনও ইংরেজি পরীক্ষা দেননি। করোনার জানান,ওই কর্মী ৯৯৯ কল হ্যান্ডলারের সঙ্গে কথা বলার সময় "ব্রিদিং" (শ্বাস নিচ্ছে) এবং "বিøডিং" (রক্তক্ষরণ) এই দুই শব্দের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। একইভাবে "এলার্ট" এবং "এলাইভ" শব্দের পার্থক্যও তিনি ধরতে পারেননি। এই ধরনের ভুল বোঝাবুঝি জরুরি পরিস্থিতিতে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
শ্যাডো হোমের সেক্রেটারি ক্রিস ফিল্প বলেন, "ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রায় দশ লাখ মানুষ ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না—কেউ কেউ একেবারেই পারেন না। আমরা আগেই এক ধরনের সমন্বয় সংকটে ভুগছি, আর এখন জানা যাচ্ছে যে প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ ভাষা পরীক্ষার ভুল ফল পাওয়ার পর ভিসা পেয়েছেন। যারা অনুচিতভাবে ভিসা পেয়েছেন, তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।"
তিনি বলেন,"মানুষ এখানে এসে যদি কখনও ইংরেজি না শেখে, তাহলে তারা সমাজে মিশতে পারে না এবং রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করে স্বতন্ত্রভাবে জীবন গড়ে তুলতেও পারে না। এটি একটি ভয়াবহ ব্যর্থতা।"
এছাড়াও আলাদাভাবে জানানো হয়েছে, কিছু মানুষ অপরাধীদের টাকা দিয়ে আগেই ফাঁস হওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিনে আইইএলটিএস পরীক্ষায় জালিয়াতি করেছে।
বাংলাদেশে পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা ঘুষের মাধ্যমে পাওয়া আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের অগ্রিম কপির জন্য মানুষের কাছ থেকে এক হাজার থেকে আড়াইহাজার পাউন্ড পর্যন্ত অর্থ নিচ্ছিল।
ভিয়েতনামে, গত ফেব্রæয়ারিতে ব্রিটিশ কাউন্সিল শেষ মুহূর্তে একটি নির্ধারিত পরীক্ষা বাতিল করে একটি "ব্যাক-আপ" সংস্করণে পরিবর্তন করেছিল, যার ফলে প্রশ্ন ফাঁসের জল্পনা সৃষ্টি হয়। সেই সময় কাউন্সিল স্বীকার করেছিল যে ফাঁস হওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রির চেষ্টা বেড়েছে। এছাড়া চীনেও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কিছু ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে শিক্ষার্থী নিয়োগ স্থগিত করেছে,কারণ ভিসা ব্যবস্থার দুর্নীতি সম্পর্কে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুপার্ট লো গত পাঁচ বছরে ইউকে ভিসা এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃক কতগুলো জাল আইইএলটিএস সার্টিফিকেট চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে হোম অফিসের কাছে জবাব চেয়েছেন। তবে তাকে জানানো হয়েছে যে এই তথ্য খুঁজে বের করার খরচ "অনেক বেশি" হবে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল মূলত তার বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে স্ব-অর্থায়ন করে থাকে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পরীক্ষা নেওয়াও অন্তর্ভুক্ত। তবে এটি পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে করদাতাদের অর্থায়নে একটি টপ-আপ অনুদানও পেয়ে থাকে।
কোভিড-১৯ এর সময়কালে নেওয়া একটি সরকারি ঋণ বাবদ ব্রিটিশ কাউন্সিলের ১৯৭ মিলিয়ন পাউন্ডের ঋণ রয়েছে, যা পরিশোধ করতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফলের ত্রুটির কারণে যদি কোনো ক্ষতিপূরণের দাবি ওঠে, তবে তা তাদের আর্থিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলবে।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র দপ্তর ইংরেজি পরীক্ষা ব্যবস্থা করার জন্য ৮১৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি নতুন পাঁচ বছরের চুক্তি করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলকে এই চুক্তির জন্য দরদাম করার সময় অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।
আইইএলটিএস-এর একজন মুখপাত্র বলেন,"আইইএলটিএস সম্প্রতি এমন একটি সমস্যা শনাক্ত করেছে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী অল্প সংখ্যক পরীক্ষার্থী আগস্ট ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে ভুল ফলাফল পেয়েছিলেন।এই সময়ের মধ্যে নেওয়া আইইএলটিএস পরীক্ষাগুলোর ৯৯ শতাংশের বেশি অপ্রভাবিত ছিল এবং বর্তমানে চলমান আইইএলটিএস পরীক্ষাগুলোতে আর কোনো সমস্যা নেই।"
ক্ষতিগ্রস্থ পরীক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,আমরা তাদের সঠিক ফলাফল প্রদান করেছি, আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ করেছি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছি। আমরা সমস্ত সংশ্লিষ্ট অংশীদার এবং কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ রাখছি।
তিনি আরও বলেন,প্রতি বছর আমরা যে লাখ লাখ আইইএলটিএস পরীক্ষা পরিচালনা করি,তার সততা রক্ষা করার জন্য আমাদের কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যাতে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য আমরা সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।সুত্র-দ্য টেলিগ্রাফ, ছবি: অ্যালামি

ডেইলি খবরের সর্বশেষ নিউজ পেতে Google News অনুসরণ করুন।
আপনার মতামত লিখুন :