রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১

প্রশাসনে বাড়ছে বিতর্কিত কর্মকান্ড! এক বছরেই এক হাজার অপরাধ

ডেইলি খবর ডেস্ক

প্রকাশিত: মে ২২, ২০২৪, ১০:৪৬ এএম

প্রশাসনে বাড়ছে বিতর্কিত কর্মকান্ড! এক বছরেই এক হাজার অপরাধ


বিতর্কিত কর্মকান্ডের কঠোর সাজা হয় না বলে প্রশাসনে বাড়ছে বিতর্কিত কর্মকান্ড। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা এসি ল্যান্ডরা ভুমির দলিলজালিয়াতিতে সহযোগীতা করা একের অন্যেও নামে নাম কারিজ করে দেওয়াসহ নানারকম অপরাধে বেশী জড়িত বলে জনপ্রশাসনে এন্তার অভিযোগ জমা পরছে। ফলে দিনদিন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও বাড়ছে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তিরস্কার ও বেতন হ্রাসের শাস্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গুরুতর অপরাধের কি শাস্তি হলো তার দন্ড-মুন্ডও জনগন জানতে পারেনা। অপরাধে জড়িয়ে পরা এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগ নবীন হওয়ায় কম শাস্তির পাশাপাশি বড় দায় থেকেও অনেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রশাসনে বেড়েই চলেছে বিতর্কিত কর্মকান্ড। যা দেশের অন্যান্য অপরাধীরাও উৎসাহিত বোধ করছে। একাধিক জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁকফোকরে তিরস্কার কিংবা বেতন হ্রাস করে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি না দেওয়ায় প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ার প্রবনতাও অব্যাহত আছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা সংস্কার করা প্রয়াজন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাায় এক হাজার কর্মকর্তার নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জন সহকারী সচিব, আটজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, সাতজন উপসচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে তদন্ত শেষে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়নি।
সুত্র জানায় অবসরে যাওয়া কানুনগোর আইডি ব্যবহার করে নিয়মবহির্ভূতভাবে সাতটি নামজারি মামলা অনুমোদন করেন বগুড়া সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি ল্যান্ড) বীর আমির হামজা। নামজারি মামলা অনুমোদনের পর সৃষ্ট নামজারি খতিয়ানে ওই কানুনগোর স্বাক্ষরও ব্যবহার করেছেন তিনি। এই গুরুতর অনিয়মে লঘুদন্ড হিসেবে গত ৯ এপ্রিল আমির হামজার বেতন কমানো হয়েছে।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অনিয়ম করায় মো. রাকিবুজ্জামানের বেতন কমানো হয়েছে। তাঁকে শাস্তি দিয়ে গত বছর ১৬ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এসি ল্যান্ড থাকার সময় যমুনেশ্বরী নদীর বালু উত্তোলনে একজনের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ায় দুই বছরের জন্য বেতন গ্রেডের নিম্নতম ধাপে অবনমনের শাস্তি দেওয়া হয় তাঁকে।
দুমকী উপজেলার সাবেক ইউএনও আল ইমরান নিলাম ডাকের মাধ্যমে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকার বার্জ ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তাঁর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছর বন্ধ রেখে গত ৫ মার্চ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানের জমি বেআইনিভাবে অধিগ্রহণ দেখিয়ে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তখনকার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রমথ রঞ্জন ঘটকের বিরুদ্ধে।
বড় এই জালিয়াতির ঘটনায় গত ৪ এপ্রিল তাঁকে লঘুদন্ড দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সহকারী সচিব পদে তাঁর পদাবনতি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রমথ রঞ্জন ঘটক বর্তমানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে উপপ্রধান (হাইড্রোলজিস্ট) হিসেবে কর্মরত আছেন।
একইভাবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সাবেক উপপরিচালক এরশাদ উদ্দিনকে অসদাচরণের দায়ে দুই বছরের জন্য, কক্সবাজারের সাবেক এডিসি মোহাম্মদ জাফর আলমকে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে তিন বছরের জন্য বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমন করা হয়েছে। গত বছর জুন ও জুলাই মাসে তাঁদের এই শাস্তি দেওয়া হয়। 
ভূমি সংস্কার বোর্ডের সাবেক সহকারী ভূমি সংস্কার কমিশনার, বর্তমানে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামাল মোহাম্মদ রাশেদ পণ্য ও সেবা ক্রয় সংক্রান্ত আইন-বিধির নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় গত ১৭ জানুয়ারি তাঁকে তিরস্কারসূচক লঘুদন্ড দেওয়া হয়। 
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহল আমীন সেখানে কর্মরত অবস্থায় নিজের পদবি গোপন করে নিজের ও স্ত্রীর নামে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২২-এর জন্য আবেদন করেছিলেন। পুরস্কার প্রদানসংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি ওই আবেদনে জেলা ও বিভাগীয় কমিটির কাছে সুপারিশও করেছিলেন। এ ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় ‘অসদাচরণের’ দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে সম্প্রতি তাঁকে তিরস্কারসূচক লঘুদন্ড দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি শুধুই তিরস্কার, এটা ভাবা যায় না। পৃথিবীর কোনো দেশে দুর্নীতির মতো অপরাধের জন্য তিরস্কারের মতো লঘুদন্ডের বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতিপরায়ণ হলে তাঁদের তিরস্কারের মতো লঘুদন্ড দিয়ে চাকরিতে বহাল রাখার বিধান রেখে ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে। আবার যাও লঘুদন্ড দেওয়া হয় তা আবার কৌশলে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। যত সাজা প্রশাসনের বাইওে থাকা অপরাধী জনগণের উপর গিয়ে পরে।
‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ’ ও ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর গত বছর ২৩ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়জুন্নেছা আক্তার লঘুদন্ড পেয়েছিলেন। শাস্তি দেওয়ার ছয় মাস না যেতেই ১ আগস্ট ‘নবীন কর্মকর্তা’ বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা (অব্যাহতি) পান তিনি।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সাংবাদিক নির্যাতন করেও প্রভাব খাটিয়ে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। নীলফামারী জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিনের বিরুদ্ধে বালুমহালের ইজারার টাকাসংক্রান্ত অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় দুই বছরের জন্য তাঁর বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের লঘুদন্ড দেওয়া হয়। পরে নাজিয়া শিরিনকে এই লঘু দন্ডাদেশ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, ‘জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জনগণের সেবক। সেবক হিসেবে সেবা দেওয়ার জন্য তাঁদের অনেক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবু এসব ঘটনার কথা শুনে বিস্ময় লাগে। প্রশাসনে এমন ঘটনা কেন বারবার ঘটছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া দরকার। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কর্মকর্তারা সতর্ক হবেন।’
প্রশাসনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রশাসনে বাড়ছে বিতর্কিত ঘটনা কমছে না ,বাড়ছে যা চলমান। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমাম আল রাজী টুলুর বিরুদ্ধে গত ২০ মার্চ রাশেদা খানম নামের বৃদ্ধ এক নারীকে নিজ কার্যালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে। উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় রাশেদার ছেলেকে আটক করতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে রাশেদাকে আটক করে আনা হয়। পরে জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম জানিয়েছিলেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গেলে ইউএনওর গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। হামলার পেছনে ওই নারীর ইন্ধন ছিল। তাই তাঁকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু মানবিক কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত ১৪ মার্চ খবর সংগ্রহ করতে গেলে পাঁচ সাংবাদিককে নিজ কার্যালয়ে আটকে রেখে হুমকি দেন লালমনিরহাট সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ-আল-নোমান। পরে খবর পেয়ে ওই জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) টি এম এ মমিন সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের মুক্ত করেন। অবশ্য তার পরদিন আবদুল্লাহ নোমানকে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় বদলি করা হয়। গত ৮ মার্চ শেরপুরের নকলায় ইউএনও কার্যালয়ে তথ্য চাইতে গেলে স্থানীয় এক সাংবাদিককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসদাচরণের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অভিযোগ ওঠে, তথ্য চাওয়ায় ওই সাংবাদিকের ওপর ক্ষুব্ধ হন ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন। পরে অবশ্য ওই সাংবাদিক জামিনে মুক্তি পান। এদিকে তথ্য কমিশন ঘটনার তদন্তে নামে। তথ্য প্রদানে অসহযোগিতা এবং তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্থ করায় ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তথ্য কমিশন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে।
গত ১২ মার্চ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানকার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তর্কে জড়ান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যবসায়ীর কাগজপত্র দেখতে চান। তখন ব্যবসায়ী বলেন, ‘হোল্ড অন’। শব্দটি ভালোভাবে নেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।
প্রশাসনের এসব অপরাধ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যখন বিভাগীয় ব্যবস্থা শুরু হয়, তখন তার অপরাধটা কী, তা বিভিন্ন শুনানির মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে। এরপর একজন কর্মকর্তা যখন দোষী সাব্যস্ত হন, তাঁর অপরাধ অনুযায়ী গুরু বা লঘু শাস্তি পান। মন্ত্রী বলেন, ‘প্রশাসনে অসদাচরণের ঘটনা খুব বেশি না। তবু যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হয়।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের একাধিক  সুত্রের সাথে আলাপ করে জানা গেছে প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তরা নানারকম অপরাধকর্মকান্ডে বা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরলে তাদেও বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কব্যবস্থা,শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যেকেই ক্ষমতাবান নানারকম লাইনে ঢুকে তাদের দোষদ্রæটি থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে অন্যরা উৎসাতিহ হয়।

 

ডেইলি খবর টুয়েন্টিফোর

Link copied!