দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা টাঙগুয়ার বিল পরিবেশ বিপন্নের পথে। মাছ, পাখি, গাছপালা, বন সবকিছুই আছিল। হাওরে এখন দেশীয় প্রজাতির কোনো মাছই পাওয়া যায় না। আগে রাতে পাখির শব্দে ঘুম হইতো না। এখন দিনের বেলায়ও পাখি দেখা যায় না।’ কথাগুলো হাওরের ফেরিওয়ালা মো. রাজা মিয়ার। নৌকা থেকে আঙুল দিয়ে করচগাছ কাটার ক্ষত দেখিয়ে বলেন,‘গাছগাছালি,বনজঙ্গল কেটে জীববৈচিত্র্যের আধারকে গলাটিপে হত্যা করা হইতাছে। মনে হয় এই হাওরের মালিক-কর্মচারী কেউই নাই।’
রাজা মিয়া কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে। স্থানীয়দের মতে, এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই হাওর। কেউ কেউ বলছেন, পর্যটন বা হাউসবোটের কারণে হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, প্রশাসনের কোনো নজরদারি না থাকায় বৈচিত্র্য হারাচ্ছে হাওর।
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলাধীন ১৮টি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত হাওর টাঙ্গুয়ার। এই হাওরে ছোট-বড় ১২০টি বিল রয়েছে। ৮৮টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ২৮০২ দশমিক ৩৬ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই হাওরকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি এই হাওরে গিয়ে দেখা গেল, চারদিক থেকে আসছে ইঞ্জিনের বিকট শব্দ, সঙ্গে পর্যটকের হুল্লোড়। ওয়াচ টাওয়ারের কাছের গাছগুলোতে যদিও হাউসবোট নেই। তবে কাছেই গোলাবাড়ি, জয়পুর গ্রামসংলগ্ন এলাকাসহ গোটা হাওরেই বিচরণ করছে পর্যটকবাহী হাউসবোট।
যদিও টাঙ্গুয়ায় হাউসবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত হোসেন আকন্দের দাবি, এই বোটগুলো তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর হয়ে ওয়াচ টাওয়ারের গোলাবাড়ির কিঞ্চি নদী দিয়ে টেকেরঘাটে যায়। এরপর রক্তি নদী হয়ে জাদুকাটা গিয়ে আনোয়ারপুরের লাইন দিয়ে সুনামগঞ্জে ফেরত আসে। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর পড়ে না।
তবে হাওরে ঘুরে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। পানিতে ভাসতে দেখা গেল প্লাস্টিক বর্জ্য, তেল-মবিল। এতে দূষিত হচ্ছে জলজ পরিবেশ। টাঙ্গুয়ার-তীরবর্তী একটি রিসোর্টের স্বত্বাধিকারীর বলেন, ইঞ্জিনের নৌকা ছোট-বড় দুইটাই হাওরের জন্য ক্ষতিকর। ইঞ্জিনের শব্দ, ময়লা-আবর্জনা, মলমূত্র প্রকৃতি-পরিবেশ নষ্ট করছে। প্রশাসনের ভূমিকাও অনেকটা ঢিলেঢালা। সবকিছু নিয়মের মধ্যে আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
কয়েক দশক ধরে টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার সামগ্রিক পরিবেশের অবনতি ঘটছে। পরিবেশগত ঐতিহ্য ও গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সরকার বিশাল এই হাওরকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটাপন্ন জলাভূমি (ওয়েটল্যান্ড) হিসেবে চিহ্নিত করে রামসার কনভেনশনের অধীনে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
মাছ-পাখি নেই হাওরে-কেবল সুনামগঞ্জ নয়,পুরো দেশেই হাওরটি শীতের অতিথি পাখিদের ‘স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটত। বিশ্বের বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতির পাখি এ বিশাল হাওরে শীতকালে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে। তবে সেই চিত্র এখন আর নেই। বন্য প্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু জলচর পাখিশুমারির এ বছরের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১৯৯২ সালের পর এ বছর সবচেয়ে কম পাখি এসেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। শীতকালে একসময় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারের মতো পাখির দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু চলতি বছর পাখি এসেছে মাত্র ৩৪ প্রজাতির ২২ হাজার ৫৪৭টি।
দেশের মৎস্যসম্পদের অন্যতম উৎস টাঙ্গুয়ার হাওর। এখানে ১৪০টির বেশি প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ পাওয়া যেত। তবে সেই মাছ উধাও হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সুনামগঞ্জের সমন্বয়ক সজল কান্তি সরকার বলেন, ‘ইঞ্জিনচালিত যানের পাখা ঘূর্ণনের সঙ্গে পেট্রল, মবিল, তেল পানিতে গিয়ে মিশছে; যা মাছ, পাখি, উদ্ভিদসহ গোটা প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। হাওরের ক্ষতি করে হলেও পর্যটন টিকিয়ে রাখার যে মচ্ছব চলছে, তাতে কিছুই থাকবে না।’
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, পানিতে ফেলা বর্জ্যের অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে। এই বর্জ্য পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়; যাতে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জরুরি উপাদান নষ্ট হয়ে যায়।
উদ্যোগ নেই প্রশাসনের-হাওরে ইজারাপ্রথা বাতিলের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আনসার সদস্যদের পাহারা ছিল। বর্তমানে ঢিলেঢালা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মাছ-পাখি শিকার থেকে পর্যটন সবকিছুতে চলছে হাওরে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানিয়েছেন, টাঙ্গুয়া নিয়ে বর্তমানে কোনো বিশেষ প্রকল্প নেই।প্রশাসন হাওরের দেখভাল করছে। হাওরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা আছে।
তবে শাবিপ্রবির বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, জীববৈচিত্র্যের জন্য যে পরিবেশ থাকা দরকার, তা দীর্ঘদিন ধরে হাওরে অনুপস্থিত। তিনি বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্যের প্রধান উপাদান হিজল, করচ, ঝোপঝাড়, জলাবন একেবারে কমে গেছে। পাখি ও বন্য প্রাণীর নিরাপদ পরিবেশ রক্ষায় হাওরে বনায়ন সৃষ্টিও জরুরি।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন,‘সবাই চায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা হোক। আবার আমরা অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনকেও উপভোগ করছি। গবেষণার মাধ্যমে সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে একটি মডেল দাঁড় করাতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
এ প্রসঙ্গে গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন, রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার তদারকিতে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। তিনি বলেন, পৃথিবীর বহু জায়গায় এ রকম পর্যটনের সুযোগ আছে। তবে সেটা নিয়মতান্ত্রিক। সরকারের পর্যটন, প্রশাসন, হাওর মাস্টারপ্ল্যান—সবখানেই নির্দেশনা শুধু কাগজে-কলমে। কোথাও কোনো নিয়মতান্ত্রিকতা নেই। সবকিছু নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।সংগৃহীত
আপনার মতামত লিখুন :