স্বাস্থ্যসেবায় সম্মুখ যোদ্ধাদের সহৃদয়তায় আমরা চিরকৃতজ্ঞ
প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, মে ৮, ২০২০
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটাপন্ন অবস্থায় যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে সম্মুখে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, সেসব নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে সাহস বা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। নিঃসন্দেহে, আমাদের এই লড়াইয়ের আসল নায়ক আপনারাই।
পৃথিবীর প্রায় সবক'টি দেশের মতোই কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে এই ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা দুইশত ছাড়িয়েছে। অসংখ্য মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলেও একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে এই সংক্রমণ প্রকাশ পায়।
এদের মধ্যে রয়েছেন অনেক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী- যারা অকুতোভয়ে, নিজের জীবন বিপন্ন করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদেরকে এই ব্যাধি থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এরা সাহসী যোদ্ধা। প্রতিদিনই আমরা তাদের কাছে অধিকতর ঋণী হয়ে উঠছি।
আমি নিজেও একজন চিকিৎসক ও চিকিৎসকের মা। আমার লন্ডন প্রবাসী দুটি কন্যা এবং জামাতা সবাই ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত এবং বর্তমান সময়ে তারা প্রতিদিনই করোনা রোগীদেরই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। একজন মা হিসাবে এই চিন্তাটি আমি দূর করতে পারি না। হাজার হাজার মাইল দূরে বসে ভয় পাই- কখনো বা নিভৃতে চোখের জল ফেলি।
কিন্তু যখন ওদের সঙ্গে কথা বলি, তখন উদ্দীপ্ত বোধ করি। ওরা আমাকে বলে, 'মা এটি তো আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি পিছিয়ে যাই, তবে সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে?' ওরা বলে, ওদেরও সুরক্ষা সরঞ্জামের কিছু ঘাটতি রয়েছে, তবু যতটা সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করেই তারা কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও মনটা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। মনে হয়, একজন মা হিসাবে এটি আমার অনেক পাওয়া।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা আরও কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে সীমাবদ্ধতা আরও অনেক বেশি। সরকার তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ জনগণ যার যতটুকু করা সম্ভব, তাই নিয়ে মানবতার সেবায় নিয়োজিত।
এই মহাদুর্যোগ একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। অদৃশ্য আনুবীক্ষণিক ভাইরাস মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে অতি দ্রুত। এটি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে চলা। অর্থাৎ, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং অতি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে না যাওয়া।
আমরা সকলেই যদি দায়িত্বশীল হই, তবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে না। সর্বোপরি চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জীবনের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
মনে রাখা দরকার, এই ভাইরাস শরীরে ঢুকে পড়লেই সেটি জীবন শঙ্কার কারণ হবে না; অধিকাংশ মানুষই সামান্য শুশ্রূষায় সেরে উঠবেন। মাত্র শতকরা পাঁচ থেকে সাত ভাগের দরকার পড়বে হাসপাতালের বিশেষায়িত চিকিৎসা। অতএব, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এই সংক্রমণ কমানো ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই।
আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, এই দুর্যোগ খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। অমানিশা দূর হয়ে ভোরের আলো ফুটবেই। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে অদম্য শক্তি। এই সম্মিলিত শক্তির বিজয় আমরা দেখেছি ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। এই সুপ্ত সামাজিক শক্তির জয় আমরা বারেবারেই দেখি বন্যা, খরা আর সাইক্লোনের সময়। এই মুহূর্তে আমাদেরকে ধৈর্য ধরে আরও কিছুদিন ঘরে থাকতে হবে। এই পবিত্র রমজান মাসে আমরা কি কষ্ট করে ঘরে থাকাটাকে সংযমের অংশ হিসাবে গণ্য করতে পারি না?
আসুন আমরা সকলেই নিজে থেকে দায়িত্বশীল হয়ে আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য তাদের কাজটি সহজে করার সুযোগ করে দেই। তাদের ঘরেও আপনজনেরা দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছেন। তারাও আমার-আপনার মতোই মানুষ; আর এই ভাইরাস কোনো রকম বাছবিচার করে না। আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমির চিকিৎসকদের হার না মানা মনোভাব দেখে সত্যি গর্বিত। তাদেরকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটাপন্ন অবস্থায় যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে সম্মুখে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, সেসব নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে সাহস বা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। নিঃসন্দেহে, আমাদের এই লড়াইয়ের আসল নায়ক আপনারাই। এই মহামারি চলাকালীন সময়ে আপনাদের প্রতিশ্রুতি, সাহস, দক্ষতা, মমত্ববোধ এবং কর্মতৎপরতার উদাহরণ সত্যিই সকলের কাছে বহুল প্রশংসিত।
আপনারা যে ত্যাগ স্বীকার করছেন, তার জন্য আমার এবং দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রতিনিয়ত আমরা আপনাদের সুস্থতার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আমাদের জীবন আপনাদের কাছে ঋণী, আর তাই আমরা আপনাদের সকলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
লেখক:
ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি, এমপি
সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-১
সদস্য, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ীকমিটি