তারা করেন সরকারি চাকরি। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্সসহ বিপুল সম্পদ। শুধু যে সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা-ই নয়। তাদের ক্ষমতার দাপটে তটস্থ থাকেন অনেকেই। ‘গুণবান’ এই চারজন হলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা সহকারী অথরাইজড অফিসার, প্রধান ইমারত পরিদর্শক, অফিস সহকারী ও বেঞ্চ সহকারী হিসেবে কর্মরত। একজন বরখাস্ত হয়েও দাপট কমেনি একবিন্দুও। নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও রাজউকের আট জোনেই তাদের প্রভাব।
ফাইল গায়েব, প্রবাসীদের হয়রানি, জাল-জালিয়াতি করে রাজউকের প্লট বিক্রি, নকশা অনুমোদনের নামে টাকা আদায়সহ অনিয়ম, দুর্নীতির নানা ঘটনায় সমালোচিত এই চারজন হলেন সহকারী অথরাইজড অফিসার ইলিয়াস মিয়া, প্রধান ইমারত পরিদর্শক আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু, অফিস সহকারী জাফর সাদেক ও বরখাস্ত বেঞ্চ সহকারী আবুল বাশার শরীফ। রাজউকে ‘কুতুব’ হিসেবে পরিচিতি তাদের।
জানা যায়, আবুল বাশার শরীফ গত বছরের ২৫ আগস্ট চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। প্রতারণার অভিযোগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি জাফর সাদেককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। একই জোনে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠায় ইলিয়াস মিয়াকে সম্প্রতি বদলি করা হয়। আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু সহকারী অথরাইজড অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা থাকায় পদোন্নতি স্থগিত করা হয়।
আয়কর ফাইলে সব উল্লেখ করা আছে দাবি করে ইলিয়াস শরীফ বলেন, ‘কালবেলার সঙ্গে আর কোনো কথা বলব না।’ বাশার শরীফ বলেন, ‘মামলা মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত আছি। জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ অফিস ও বাসায় যোগাযোগ করেও আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু ও জাফর সাদেকের দেখা মেলেনি, বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইলিয়াস মিয়ার সম্পদ অনুসন্ধানে যে তথ্য মিলেছে: রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী থানার এ ব্লকের ৮/১ নম্বর রোডের ১৫/১৬ নম্বর বাসা। আশপাশের সব ভবনে হোল্ডিং নম্বর প্লেট থাকলেও এই বাসাটিতে নেই। এ কারণে নতুন যে কারও বাসা খুঁজে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। সাড়ে ছয়তলার এই বাসার ভবনের নিচতলায় মার্কেট ও কোচিং সেন্টার। তবে কোচিং সেন্টারটির সাইনবোর্ড নেই। অন্য পাঁচতলার প্রতিটি তিন ইউনিটে বিভক্ত। ইউনিটগুলো আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ওপর তলায় এক ইউনিটের একটি ফ্ল্যাট। ভবনটি সাড়ে তিন কাঠা আবাসিক প্লটের ওপর নির্মাণ হয়েছে। ভবন মালিক ইলিয়াস মিয়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে প্ল্যান পাশের সময় ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেলেও করেছেন সাড়ে ছয়তলা। রাজউকের কারও অবশ্য অনুমোদনহীন অংশ চোখে পড়েনি। কারণ, ইলিয়াস মিয়া নিজেই রাজউকের কর্মকর্তা।
জানা গেল, পরিবার নিয়ে উত্তরায় বসবাস করেন ইলিয়াস মিয়া। ভবনটি দেখভালের দায়িত্বে আছেন ইলিয়াসের ভগ্নিপতি আব্দুল করিম। বসবাস করেন তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে। ভবনে হোল্ডিং নম্বর প্লেট নেই কেন, সে বিষয়ে কথা বলতে নারাজ তিনি। ভাড়া থেকে ইলিয়াসের মাসে আয় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ইলিয়াস মিয়াকে সবাই জমিদার নামে ডাকে। রাজধানীর উত্তরা, উত্তরখান, নিকুঞ্জ ও কাটাসুরেও বাড়ি আছে তার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় উপ-ইমারত পরিদর্শক হিসেবে রাজউকে যোগ দেন ইলিয়াস। সে সময় সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৪ হাজার ৩০০ টাকা। পরে পদোন্নতি পেয়ে ইমারত পরিদর্শক ও প্রধান ইমারত পরিদর্শকও হন। চাকরিরত অবস্থায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে হন সহকারী অথরাইজড অফিসার। এখন তার বেতন প্রায় ৬০ হাজার টাকা। রাজউকের ৩ নম্বর জোনে প্রায় সাত বছর কর্মরত ছিলেন ইলিয়াস মিয়া। এই জোনে থাকার সময়ই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হন। গত ৫ মার্চ ১ নম্বর জোনে বদলি করা হয় তাকে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা হওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, নিকুঞ্জ-২ এর ১০ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর ছয়তলা বাড়ির মালিক ইলিয়াস মিয়া ও তার পরিবার। উত্তরখানের ৬ নম্বর রোডের ৭৫/বি নম্বর বাসাটির মালিকানায় আছেন ইলিয়াসের স্ত্রী। উত্তরা মডেল টাউনের ১২ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ৫৩ নম্বর বাসার ৫, ৬ ও ৭ তলার মালিকানায় আছেন ইলিয়াস ও তার স্ত্রী। মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ৫ নম্বর রোডের ৭৬ নম্বর বাড়ির মালিকানায়ও আছেন ইলিয়াস ও তার পরিবার।
ইলিয়াস মিয়া অবশ্য অভিযোগ করেছেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। অবৈধ কোনো সম্পদ নেই দাবি করে তিনি বলেন, যা কিছু আছে আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
আওরঙ্গজেব নান্নুর সম্পদের শেষ নেই: রাজধানীর ১৭৯ ইব্রাহীমপুরের হক হেরিটেজ। সাত কাঠা জমির ওপর ১০ তলা এই ভবনটির মালিক রাজউকের প্রধান ইমারত পরিদর্শক আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু। ভবনের নিচতলায় গ্যারেজ আর অন্য ফ্লোরগুলোর প্রতিটিতে চারটি করে ফ্ল্যাট আছে। ২৫৪ ইব্রাহীমপুরে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সন্ধান মেলে, যার মালিকানায় আছেন নান্নু ও তার পরিবারের সদস্যরা। পাঁচ কাঠার ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণ হবে সেখানে। নিচতলায় কার পার্কিং এবং অন্য ফ্লোরগুলোর প্রতিটিতে তিনটি করে ফ্ল্যাট হবে। ১১২/১ ইব্রাহীমপুরে ‘ইবিএল বলাকা’র মালিকানায়ও আছেন নান্নু ও তার পরিবার। ৯ তলা ভবন এটি। কাছাকাছি সোয়া চার কাঠার ওপর ছয়তলা ভবন আছে নান্নুর। ভবনটিতে হোল্ডিং নম্বর নেই। বাড়ির নাম প্রধান মঞ্জিল। জানা গেল ভবনটির হোল্ডিং নম্বর ২৫১/১। উত্তরা ও চাঁদনী চকে ৮টি দোকান আছে নান্নুর।
বর্তমানে রাজউকের জোন ৬-এ কর্মরত নান্নু নব্বই দশকের মাঝামাঝি উপ-ইমারত পরিদর্শক হিসেবে রাজউকে যোগ দেন। সে সময় বেতন পেতেন ৪ হাজার ৩০০ টাকা। পরে পদোন্নতি পেয়ে ইমারত পরিদর্শক ও প্রধান ইমারত পরিদর্শক হন। চাকরিরত অবস্থায়ই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন। এখন বেতন পান প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ২৩ তলা ভবন এফআর টাওয়ারের নবমতলায় অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। ওই মামলায় তৎকালীন ইমারত পরিদর্শক নান্নুর নাম ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ যায়।
নান্নুর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুর্নীতির একাধিক মামলার বিচার ও তদন্ত চলমান।
জাফর সাদেক, অনিয়ম-দুর্নীতি করেও কিছুই হয় না যার: দুর্নীতি, অনিয়ম, ফাইল গায়েব আর প্রতারণার ঘটনায় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাজউকের অফিস সহকারী জাফর সাদেক। বর্তমানে জামিনে আছেন। রাজধানীর শান্তিনগরে ৩৩ নম্বর পীর সাহেবের গলির মেহমান টাওয়ারের ছয়তলায় (ফ্ল্যাট নং ৬/এ) ১ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফিট আয়তনের প্রায় কোটি টাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাস করেন জাফর। আফতাবনগরের ডি ব্লকের ১ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর প্লটে সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর আটতলা বাড়িও আছে তার। মাসে ভাড়া পান দেড় লাখ টাকা। এক্স-প্রিমিও ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। জাফর সাদেকের স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের নামে নয়াপল্টনের গাজী ভবন শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় একটি দোকান আছে। দোকান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া পান ৪৫ হাজার টাকা। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানাধীন সিজিয়ারা বাজারের মকিমপুর গ্রামেও ১২ শতক জমি আছে জাফরের।
জাফরের আরেক স্ত্রীর নাম রিপা। রিপার নামে বনশ্রীতে আছে পাঁচতলা বাড়ি। এলিয়ন ব্র্যান্ডের দুটি প্রাইভেটকার ব্যবহার করেন তিনি।
পূর্বাচল সেলে কর্মরত জাফর সাদেক। সরকারি চাকরির ১৬তম গ্রেডে পিএ হিসেবে রাজউকে যোগদান করেছিলেন ২০০৬ সালে। সে সময় বেতন পেতেন প্রায় ৮ হাজার টাকা। এখন বেড়ে তার বেতন স্কেল দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার টাকা। বেতন পান ৪৫ হাজার টাকা।
শুধু জনতা ব্যাংকের এক হিসাবেই জাফরের আছে ২৭ লাখ টাকা। মোট পাঁচটি ব্যাংক হিসাব আছে তার। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জাফর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। অফিসকে না জানিয়ে থাইল্যান্ড ভ্রমণ করলেও কিছুই হয়নি তার। ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নেতা থাকা অবস্থায় ২০০৫ সালে পল্টনে আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি চালিয়ে সে সময় আলোচিত হয়েছিলেন জাফর সাদেক। এখন অবশ্য রাজউকে জাফরের পরিচয় আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে।
চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেও অফিস করেন আবুল বাশার শরীফ: রাজউকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবুল বাশার শরীফ গত বছরের ২৫ আগস্ট চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। বিভিন্ন প্লটের ফাইল গায়েব করার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয় তাকে। জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতা বাশার শরীফের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য প্ল্যান পাস, প্লট জালিয়াতি, প্লটের ফাইল গায়েব, নকশা জালিয়াতি, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে হেনস্তাসহ সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগে আছে। ২০২১ সালের ১ মার্চ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বাশার। কমিটির মেয়াদ চলতি বছরের মার্চে শেষ হলেও নতুন কমিটি গঠন হয়নি। মানিকনগর পুকুরপাড়ে (৬৬/২/৩ ওয়াসা রোড) ২ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে তার। ব্যবহার করেন টয়োটা নোয়া গাড়ি।
বরখাস্ত প্রসঙ্গে শরীফ বলেন, ‘ফাইল নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত আছি। কিছুদিন পর রায় হবে। ফেঁসে যেতে পারি। এজন্য জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে ফ্ল্যাট-গাড়ি থাকার তথ্য অস্বীকার করেন বাশার শরীফ।