মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

৯০০০ শয্যা রোগীশূন্য

প্রকাশিত: ০৫:১৩ এএম, অক্টোবর ৩, ২০২০

৯০০০ শয্যা রোগীশূন্য

সরকারের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ক্রমেই রোগী কমছে। রোগী সংকটে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশের ১১ হাজার ৬৩৫টি সাধারণ করোনা শয্যাতে রোগী ভর্তি আছে ২ হাজার ৬২৯ জন। খালি পড়ে আছে ৯ হাজার ৬টি শয্যা। আর ৫৫৪টি আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে ২৯১ জন। খালি আছে ২৬৩টি শয্যা। রোগী শূন্যতায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঢাকা সিটির ২২টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৫টি। অন্যদিকে ঢাকার ১৮টি করোনা হাসপাতালের ৩ হাজার ৪৬৭টি সাধারণ শয্যাতে রোগী ভর্তি আছে মাত্র ১ হাজার ৭০৮জন। খালি আছে ১ হাজার ৭৫৯টি। ৩০৪টি আইসিইউ শয্যায় ১৯৭ জন রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ১০৭টি। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ৯টি করোনা হাসপাতালের ৭৮২টি শয্যার মধ্যে ১২৯ জন রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ৬৫৩টি শয্যা। ৩৯টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতে রোগী আছে। খালি আছে ২৩টি শয্যা। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অন্যান্য হাসপাতালে আরো ৭ হাজার ৩৮৬টি করোনা শয্যায় মাত্র ৭৯২জন রোগী ভর্তি আছে। খালি পড়ে আছে ৬ হাজার ৫৯৪টি শয্যা। আর ২১১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে মাত্র ৭৮টি শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ১৩৩টি শয্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন বলেন, রোগী সংকটে ৫টি ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, মিরপুর লালকুঠির হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল। বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতাল ছাড়া বাকি চারটি হাসপাতালে আবার সাধারণ রোগীদের সেবা চালু হবে। ওদিকে করোনা সংক্রমণের হার থেমে নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৮৮ ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ২৬ জন। আর অদ্যাবধি শনাক্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৩ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ হাজার ২০০ জন। যে হারে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন সেই হারে রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন না। অধিকাংশ রোগীই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন রোগীদের কথা হাসপাতালের চেয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে সুবিধা। কারণ যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক-নার্সদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, দালালদের হয়রানি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ওষুধের জন্য বাড়তি খরচের মতো ব্যাপার রয়েছে। এছাড়া শ্বাসকষ্টের রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেন দিয়ে সিরিয়াস রোগীদের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। কিছু কিছু হাসপাতালে প্রফেসর, কনসালটেন্টের দেখা মেলে না। এসব হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসক দিয়েই কার্যক্রম চালানো হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালের চেয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে রোগীরা স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। কারণ কিছু কিছু করোনা হাসপাতালে রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। সময় মতো চিকিৎসক-নার্সদের খুঁজে পাওয়া যায় না আর অসৌজন্যমূলক আচরণতো আছেই। তবে সামনে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা রয়েছে। সেজন্য অবশ্যই হাসপাতালগুলো সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সার দেশে করোনা শয্যার প্রায় অর্ধেকই রাজধানী ঢাকাতে। হাসপাতালগুলোতে রোগী সংকট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৫টি হাসপাতাল। আরো বেশকিছু হাসপাতাল রোগী শূন্য। কিছু কিছু হাসপাতাল স্বল্প রোগী নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হাসপাতালে নতুন করে রোগীও ভর্তি নিচ্ছে না। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন করে এসব হাসপাতালে আর রোগী ভর্তি নেয়া হবে না। যে সব রোগী আগে থেকে ভর্তি আছেন তারা সুস্থ হলে করোনা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো গত মঙ্গলবারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, করোনা ডেডিকেটেড ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যার সংখ্যা ২০০টি। বর্তমানে রোগী ভর্তি আছে ৭৪টি শয্যাতে। খালি আছে ১২৬টি। আইসিইউতে শয্যা সংখ্যা ১৬টি। রোগী ভর্তি ১০ জন। খালি আছে ৬টি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ২৭৫টি। ভর্তি রোগী ১৯৫ জন। খালি আছে ৮০টি। আইসিইউতে শয্যা আছে ১০টি। রোগীও ভর্তি ১০ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ শয্যা আছে ৮৮৩টি। রোগী ভর্তি ৫৮৮ জন। খালি আছে ২৯৫টি। ২৪টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ২০টিতে। খালি আছে ৪টি। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ ৩২০টি শয্যার মধ্যে ১১১ জন রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ২০৯টি। আইসিইউ ১৪টি শয্যার মধ্যে ১৪ টিতেই রোগী আছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে সাধারণ ২৫০টি শয্যার মধ্যে ১২১টিতে রোগী ভর্তি আছে। ১২৯টি শয্যা খালি আছে। ১৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৪টিতে রোগী ভর্তি। খালি আছে ১টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ২৩৪টি শয্যার ১৯১টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ৪৩টি। আইসিইউর ১৬টি শয্যার ১৬টিতে রোগী ভর্তি আছে। মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সাধারণ ১০টি শয্যার ১০টিই খালি। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের সাধারণ ১৪০টি করোনা শয্যার ৪২টিতে রোগী ভর্তি আছে। ৯৮টি শয্যা খালি। ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১২টিতে রোগী ভর্তি। খালি আছে ৪টি। বেসরকারি আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ ২০০টি করোনা শয্যার মধ্যে ৫৩টি শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। ১৪৭টি শয্যা খালি। আইসিইউ ১০টি শয্যার মধ্যে ৪টিতে রোগী আছে। খালি আছে ৬টি। সরকারি কর্মচারি হাসপাতালের সাধারণ ৬৬টি শয্যার মধ্যে ৩৯টিতে রোগী আছে। ২৭টি শয্যা খালি। আইসিইউ’র ৬টি শয্যার মধ্যে ২টিতে রোগী ভর্তি। খালি আছে ৪টি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতের সাধারণ ১৫০টি করোনা শয্যার মধ্যে ৭০টিতে রোগী আছে। ৮০টি শয্যা খালি। আসগর আলী হাসপাতালের সাধারণ ১৬৮টি শয্যার মধ্যে ২৫ জন রোগী ভর্তি আছে। ১৪৩টি শয্যা খালি। তেমনি ৩৬টি আইসিইউ শয্যার ২৭টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ৯টি। স্কয়ার হাসপাতালের সাধারণ ৭৪টি শয্যার মধ্যে ৪৭টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ২৭টি। ২৫টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতে রোগী ভর্তি আছে। ৯টি শয্যা খালি। ইবনে সিনা হাসপাতালের ৩৬টি সাধারণ শয্যার ২৮টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ৮টি। আইসিইউর’র ৬টি শয্যার সবক’টিতেই রোগী ভর্তি আছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের সাধারণ ৫৯টি করোনা শয্যার ৩০ টিতে রোগী আছে। খালি আছে ২৯টি। আইসিইউ ২২টি শয্যার ৮টিতে রোগী। খালি আছে ১৪টি। এভার কেয়ার হাসপাতালের সাধারণ ২৮টি শয্যার মধ্য ২৫টিতে রোগী ভর্তি আছে। খালি আছে ৩টি। আইসিইউর ২০টি শয্যার ১৭টিতে রোগী আছে। খালি আছে ৩টি আইসিইউ শয্যা। ইম্পালস হাসপাতালের সাধারণ ৩৪৪টি করোনা শয্যার ৩৯টিতে রোগী আছে। খালি আছে ৩০৫টি। ৫৬টি আইসিইউ শয্যার ৯টিতে রোগী ভর্তি আছে। ৪৭টি আইসিইউ শয্যা খালি। আর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৩০টি সাধারণ শয্যার সবক’টিতে রোগী ভর্তি আছে। আইসিইউ’র ১২টি শয্যারও সবক’টিতে রোগী আছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, রোগীরা বাসায় যে সুবিধা পায় হাসপাতালগুলো সেরকম সুবিধা দিতে পারে না। খাবার দাবার থেকে শুরু করে, আলাদা থাকার ব্যবস্থা যদি থাকে আর রোগীর অবস্থা যদি খারাপ না হয় তাহলে তারা হাসপাতালে আসবে না। প্রান্তিক পর্যায়েও যারা আছে তারাও হাসপাতালে আসছে না। তারা অনেকেই চাকরি ও বাড়িওয়ালার ভয়ে গোপন করে রাখছে। সরকারের দরকার প্রান্তিক লেভেলের ওই মানুষদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা। তিনি বলেন, মানুষ হাসপাতালে আসলে সহায়তা পায়না। হাসপাতালে আসার পর নানা ইস্যুতে তাদের অনেক খরচ বেড়ে যায়। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধসহ নানা খরচ। রোগীর পেছনে অনেক দালালও লেগে যায়। বাসায় থাকলে এই খরচগুলো হয় না। তাই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন হয়রানির শিকার না হয়। আর আইসোলেশন সেন্টার হিসাবে রোগীকে হাসপাতালে না আনলে সে বাইরে থেকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে রোগ ছড়াবে। তার পরিবারের সদস্যরা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছে। ফলে ওই রোগীর কাছ থেকে তার পরিবারের সদস্যরা রোগ বহন করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। ডা. মোস্তাক বলেন, হাসপাতালের খালি বেডগুলো কমিউনিটি কোয়ারেন্টিন ও কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার হিসাবে কাজে লাগানো যায়। এটা করলে কমিউনিটিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ছাড়া যাদের বয়স বেশি, ডায়বেটিকস, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদেরকে অবশ্যই সরকারি উদ্যেগে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। যাদের হৃদযন্ত্রের সমস্যা আছে তারা বাসায় থেকে মারা যাচ্ছে কিন্তু টেরই পাচ্ছে না। তিনি বলেন, যেকোনো মূহূর্তে সংক্রমণটা বাড়তে পারে। তাই হাসপাতালের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, বড় বড় হাসপাতালে কমবেশি রোগী আছে। অনেক সময় শয্যা পাওয়া কঠিন হয়। আর যেসব হাসপাতালে মানুষ সঠিক চিকিৎসা পায় না সেগুলো খালি। যেসব হাসপাতালে প্রফেসর, কনসালটেন্ট নাই জুনিয়র ডাক্তার দিয়ে চালাচ্ছে সেগুলোতে রোগী যাচ্ছে না। কিছু কিছু হাসপাতাল নতুন করা হয়েছিল সেগুলো খালি পড়ে আছে। মানুষ যেখানে চিকিৎসা পায় সেখানেই যায়। এ ছাড়া এখন মানুষ করোনা চিকিৎসা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে। আমরাও বলি ৮০ শতাংশ রোগীর ঘরে বসে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব। আবার অনেকেই ঘরে বসে চিকিৎসা নিতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। তারা মনে করেন হাসপাতালের চেয়ে বাসায়ই ভালো সুবিধা। টেলি মেডিসিন ইন্টারনেটসহ নানা উপায়ে চিকিৎসা নিতে পারছে। এ ছাড়া থাকা, খাওয়া, সেবাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। হাসপাতালে এগুলো সম্ভব হয়না। তারপরেও আমি বলবো যাদের আগে থেকেই শারীরিক সমস্যা আছে তারা অবশ্যই হাসপাতালে যান। ঘরে থাকা তাদের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। যদি কারো অক্সিজেন লেভেল ৯২ বা তারও নিচে নেমে আসে তবে অবশ্যই তাদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে। না হলে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। অনেকেই একেবারে অন্তিম মূহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যান। এসব কারণে মৃত্যুর হারটা বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা নিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হাসপাতাল প্রশাসনের। চিকিৎসক-নার্সরা চিকিৎসা দিবে। তারপরেও অনেক সময় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ থাকে। তারা ভালোভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলেন না। তাদের সমস্যার কথা শুনেই চিকিৎসা দেয়।
Link copied!