‘এদেশকে ভালোবাসলে এদেশের রাষ্ট্রচরিত্রকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বদলাতে হবে।’
অনেকেই বিতর্ক করতে পারেন যে, ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রকে বদলে দিয়েছে, এবং ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ক্রমশঃ তার জনবান্ধব চরিত্রটি হারিয়ে ফেলছে, আমি এই যুক্তি খণ্ডানোরচেষ্টা করবো না। বরং একথাই জোর দিয়ে বলবো যে, আওয়ামী লীগের এই রাজনৈতিক চরিত্র বদল, এদেশের মানুষকে আশাহত করেছে খুউব এবং মানুষ মূলতঃ এ কারণেই রাজনীতি-বিমুখ হয়ে উঠেছে দিন দিন।
কিন্তু আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমি মনে করি আওয়ামী লীগ ও তার রাজনীতির সবচেয়ে দুর্বলতম ও ভয়ঙ্কর পরিবর্তনটি আর কিছুই নয়, দলটি তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে যে ক্রমশঃ দূরে চলে যাচ্ছে, সেটিই এদেশের জন্য বিপদ ডেকে আনবে ভবিষ্যতে কিংবা বলা ভালো যে, আজকের যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উল্লম্ফন, জঙ্গিবাদের উদ্যত ফণা এবং রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে দেশের দুর্বল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের দুঃশ্চিন্তা- এসব সবই আসলে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার নিট ফলাফল। আওয়ামী লীগ এখানে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজে ব্যর্থ হয়ে গোটা দেশকেই একটি ব্যর্থ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করছে এবং এর ভবিষ্যৎ হয়তো বাংলাদেশের একটি সম্পূর্ণ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, যার থেকে আমাদের সত্যিই আর মুক্তি নেই। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই।
একেবারে সর্ব-সাম্প্রতি যে ঘটনা দেশের রাজনীতিকে, সরকারকে এবং বিচারবিভাগকে তোলপাড় করে ছাড়ছে তা হলো ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়। এই রায় যেমন-তেমন, এই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি যে সব মন্তব্য করেছেন তা আসলে চরম রাজনৈতিক বক্তব্য। আমার বিশ্লেষণ যারা নিয়মিত পাঠ করেন তারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, আমি এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাবেই বলেছি যে, রায় যেরকমই হোক না কেন, প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে সেসব কথাই বলেছেন, যা এতোদিন ধরে এদেশের অ-রাজনৈতিক সুশীল পক্ষটি বলে এসেছে এদেশের রাজনীতিকে রাজনীতিবিদ-মুক্ত করার জন্য। ফলে এই রায় তার স্বাভাবিক মর্যাদা হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার হিসেবে এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে এই রায়ের বিরোধিতা করছে এবং আইনমন্ত্রী এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা আইনী ভাবেই এই রায়কে মোকাবিলা করবেন। সেটাই গ্রহণযোগ্য পথ।
হ্যাঁ, যেহেতু রায়টি রাজনৈতিক সেহেতু এই রায় বিষয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বক্তব্য দেবে এটাও স্বাভাবিক। যেমনটি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। তিনি এই রায় যে রাজনৈতিক রায় এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত সেকথাই তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল অনেক নেতৃবৃন্দ যখন এই রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন আর এই সমালোচনা রাজনৈতিক থাকে না, সমালোচনা নতুন পরিচয় লাভ করে, যাকে আমরা বলতে পারি সাম্প্রদায়িক আঘাত। এই সাম্প্রদায়িক আঘাতের বিরুদ্ধে এদেশে প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা এমনিতেই কমতে কমতে তলানীর দিকে এসে ঠেকেছে।