মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

সরকারী প্রকল্পের টাকা খাদকরা খাবেই!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯ এএম, জানুয়ারি ৩০, ২০২১

সরকারী প্রকল্পের টাকা খাদকরা খাবেই!

ডেইলি খবর ডেস্ক: সরকারী টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে চোরের কারসাজি বন্ধ হবে কবে। প্রকল্পের টাকার কাজ হয় নিম্নমানের। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা কাগজে থাকে বাস্তবে ঘোলাটে। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় করে নিজেদের পকেটভারি করাটাই এখন প্রতিযোগতিা হয়। এসব নিয়ে সবসময় আলোচনা-সমালোচনা হলেও কিছুদিন পুর্বের অবস্থায়ই ফিরে যায় ঠিকাদার চক্রের হোতারা। বিভিন্ন জেলায় উন্নয়ন প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে এমন অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বেহাল। হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের ওপরের ছাদ থেকে খসে পড়ছে রং। হবিগঞ্জের লাখাইয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বেহাল। হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের ওপরের ছাদ থেকে খসে পড়ছে রং। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় পাঁচতলাবিশিষ্ট একটি ডিগ্রি কলেজের নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। উদ্বোধনের আগেই ভেঙে পড়ছে দরজা। ভবনের ছাদ চুইয়ে পড়ছে পানি। আবার একই জেলায় ফায়ার স্টেশন ভবন নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট। সুনামগঞ্জের লাখাই উপজেলায় একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একটি কলেজের নির্মাণকাজ সন্তোষজনক নয়। উন্নয়ন প্রকল্প নজরদারি করা সরকারের একমাত্র সংস্থাটির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গত দুই মাসে দেশের আটটি জেলা পরিদর্শনে গিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে এসব অনিয়ম পেয়েছেন। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠিয়েছে আইএমইডি। উন্নয়নকাজের হাল দেখে ক্ষুব্ধ আইএমইডি। ভবন চালু না হতেই ভেঙে পড়ছে দরজা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চুইয়ে পড়ছে পানি। অপ্রয়োজনীয় এলাকায় ভবন নির্মাণ। আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে একটি ধারণা মিলেছে যে কাজের গতি অত্যন্ত মন্থর। কোনো প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের উপকরণ। তিনি বলেন, যেখানে প্রকল্প নেওয়া দরকার ছিল না, সেখানেও নাম ঢোকানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কাজগুলো খুবই নিম্নমানের। তবে কিছু কিছু জায়গায় ভালো কাজও চোখে পড়েছে। যেসব প্রকল্পে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে, সেসব বিষয় সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের জানানো হয়েছে। চালু না হতেই ভেঙে পড়ছে দরজা আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী,মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ডিগ্রি কলেজটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল আট বছর আগে ২০১২ সালে। কিন্তু এখনো পাঁচতলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত (বেসরকারি) কলেজগুলোর উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে আইএমইডি সচিব দেখেন,ভবনটির চতুর্থ তলায় একটি কক্ষের স্নাইডিং দরজা ঠিকমতো খোলা যায় না, আবার বন্ধ করাও যায় না। খুলতে চেষ্টা করার সময় ফলস সিলিংয়ের কিছু অংশ ভেঙে পড়ছে। আবার চতুর্থ তলার দুই দিকেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ছাদে আরসিসি ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। ভবনটির পিলারগুলোও খানিকটা বাঁকা। ফায়ার স্টেশন ভবনে নিম্নমানের ইট জানা গেছে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গত ১৩ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলার টঙ্গিবাড়ী ফায়ার স্টেশন ভবন সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, ভবনের জন্য ব্যবহার করা ইটের মান ভালো নয়। ভবনটি নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল আট বছর আগে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি ছিল যে ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করবে। কিন্তু প্রশ্রিæতি সময়ের মধ্যে কাজ তো শেষ হয়নি,উল্টো নির্মাণকাজের মান দেখে অসন্তুষ্ট হন আইএমইডির সচিব। একই দৃশ্য দেখা গেছে জেলার সিরাজদিখান ফায়ার স্টেশন ভবন নির্মাণকাজেও। সেখানেও নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভবনের কাজও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করুণ দশা: গত ২৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে যান আইএমইডির সচিব। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বিদ্যমান ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার তার ঝুলে আছে। কাজ চলমান অবস্থায় দোতলায় স্টোররুমের একদিক থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে। দোতলায় স্টোররুমের দরজার কপাট ভাঙা। কিন্তু ভাঙা দরজাতেই রং করা হয়েছে।সরকারি কেনাকাটায় আগে এত অনিয়ম দুর্নীতি ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে এই অনিয়মের প্রবণতা বেড়েছে। কারণ, বাজেটের আকার বেড়েছে। তা ছাড়া আমাদের এখানে আইনের প্রয়োগ খুবই কম। দুর্নীতি কমাতে বড় দুর্নীতিকে উদাহরণমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। এতে যারা এখন কিছু খাবে বলে বসে আছে, তারা কিছুটা সতর্ক হবে। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দোতলার অস্ত্রোপচারের যন্ত্র রাখার রুমে ময়লা কাপড়চোপড় রাখা হয়েছে। পাশেই প্রসূতি মায়েদের লেবার রুম। দোতলার পুরুষ ওয়ার্ডসংলগ্ন বাথরুম ব্যবহার করলে পানি বাইরে চলে আসছে। মহিলা ওয়ার্ডের বাথরুমেরও একই অবস্থা। এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট পড়ে আছে। এক্স-রে রুমে একটি মোটরসাইকেলও দেখা গেল। এক্স-রে রুমের সামনে দোতলার সুয়ারেজ পাইপ থেকে ময়লা পানি পড়তে দেখা গেছে।অন্যদিকে ভবনে বাথরুমের গøাস ফিটিং হয়নি। রঙের কাজও পুরোপুরি হয়নি। অপারেশন রুমের কোনো কাজই শুরু হয়নি। পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে জানালার গøাস নেই। বাথরুমের পানি নিচতলায় পড়তে দেখা গেছে। পানিনিষ্কাশন পাইপ ভাঙা। সীমানাপ্রাচীরের বেশ কয়েকটি জায়গা ভাঙা। কলাপসিবল গেটও ভাঙা। অপ্রয়োজনীয় জায়গায় হাটবাজার উন্নয়ন যেখানে হাটবাজারের জন্য ভবন নির্মাণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না, সেখানেও হাটবাজার নির্মাণ করতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। আইএমইডির সচিব গত ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার ভরপূর্ণী বাজারে গিয়ে একটি দোতলা ভবন খুঁজছিলেন। যে দোতলা ভবনটি করার জন্য গত বছরের ২৫ মার্চ ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সচিব দেখলেন, সেখানে কাজের কোনো চিহ্নই নেই। এত দূরে একটি হাটে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করলে এলাকার মানুষ কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। পরিদর্শনের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানিয়েছেন, হাটটি উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নয়। বাজারটি সরকারিভাবে ইজারাও দেওয়া হয় না। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন,ওই হাটের জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন। কিন্তু কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে কীভাবে শহর থেকে এত দূরে এমন একটি বাজারকে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে।সগত ২৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে যান আইএমইডির সচিব। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বিদ্যমান ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার তার ঝুলে আছে। কাজ চলমান অবস্থায় দোতলায় স্টোররুমের একদিক থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে। দোতলায় স্টোররুমের দরজার কপাট ভাঙা। কিন্তু ভাঙা দরজাতেই রং করা হয়েছে। আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, ভরপূর্ণী বাজারে দোতলা ভবন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা খরচের একটি চুক্তি গত বছরের ২৫ মার্চ সই হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ২ এপ্রিল থেকে ভবন নির্মাণকাজ শুরুর কথা। কিন্তু দেশব্যাপী গ্রামীণ হাটবাজার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সেই হাটে দোতলা ভবনটির কাজই শুরু হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়ম ও সরকারি কেনাকাটা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সরকারি কেনাকাটায় আগে এত অনিয়ম দুর্নীতি ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে এই অনিয়মের প্রবণতা বেড়েছে। কারণ, বাজেটের আকার বেড়েছে। তা ছাড়া আমাদের এখানে আইনের প্রয়োগ খুবই কম। দুর্নীতি কমাতে বড় দুর্নীতিকে উদাহরণমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। এতে যারা এখন কিছু খাবে বলে বসে আছে, তারা কিছুটা সতর্ক হবে। তবে কখনোই বন্ধ হবে না। যতক্ষন পর্যন্ত নীতিনৈতিকতার পরিবর্তন না হবে ততদিন সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের খাদকরা খাবেই।
Link copied!