সঞ্চয় ব্যয় করে সায়েন্স ল্যাবরেটরিকে দেউলিয়ায় ফেলে চেয়ারম্যান অবসরে
প্রকাশিত: ০৩:৩৬ এএম, আগস্ট ৩১, ২০২০
ডেইলি খবর ডেস্ক: সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিগত ৫০ বছরের সঞ্চয়ের সব অর্থ ‘অকারণে’ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিদায়ী চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ। তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, কেনাকাটা ও ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ (অতিরিক্ত সচিব) তার চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে এসব অনিয়ম করেছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা দিয়েছেন। বিসিএসআইআর লোকমুখে সায়েন্স ল্যাবরেটরি নামে পরিচিত। সায়েন্স ল্যাবরেটরির এসব ‘অনিয়ম-দুর্নীতি’ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে দুদক। প্রাপ্ত অভিযোগমতে, ফারুক আহমেদ সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিগত ৫০ বছরের সঞ্চয়ের সব অর্থ ‘অকারণে’ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ অন্য দপ্তরে বদলি করা হলেও তদবির করে দীর্ঘ সময় থেকে গেছেন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে।
তবে সম্প্রতি অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআর) যাওয়া অতিরিক্ত সচিব ফারুক আহমেদ তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি চার বছর চেয়ারম্যান থাকার সময় সায়েন্স ল্যাবরেটরির ‘ব্যাপক উন্নতি’ হয়েছে। সেখানে নানা ধরনের বিভাজনের কারণে তার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চলছে। দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, ফারুক আহমেদ সায়েন্স ল্যাবরেটরির দায়িত্ব নেন ২০১৬ সালে। নিয়োগের পরই তিনি কর্মচারী নিয়োগের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ডিপিসি (বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি) বাতিল করেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের জন্য ফারুক আহমেদ তার আস্থাভাজন নিম্ন গ্রেডের চার কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে ডিপিসি কমিটি গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ২০১৭ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ২৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন। ফারুক আহমেদ তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত উপসচিব বেনজির আহমেদের সহযোগিতায় নিয়োগ বাণিজ্য করেন। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের কাছ থেকে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়। আর এই ‘নিয়োগ বাণিজ্যে’ যারা সহযোগিতা করেছেন পরবর্তী সময়ে তাদের প্রত্যেককে বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছেন তিনি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এবং ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল দুদক থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে বিসিএসআইআরে কমিশন নেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট উল্লেখ করে অভিযোগে বলা হয়, কোনো দরপত্র আহ্বান করার আগেই নিজের পছন্দমতো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য ২০ শতাংশ অর্থ নিতেন চেয়ারম্যান। এ কাজে সহযোগিতার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আজিমকে বাদ দিয়ে জুনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী মুনির হোসেন পাটোয়ারীকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেন। মোহাম্মদ আজিম এর প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে চুপ করানো হয়। ফরিদপুরের একটি বেসরকারি কলেজ থেকে পাস করা তানিম আহমেদ নামে একজনকে সরাসরি সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেন ফারুক আহমেদ। পদোন্নতি না পাওয়া উপসহকারী প্রকৌশলী সৈয়দ মাজহারুল হক প্রতিবাদ জানালে তাকে তিন মাসের বেতন দিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং আবাসিক কোয়ার্টার থেকে উচ্ছেদ করা হয়। পরে মাজহারুল প্রতিবাদ না করার শর্তে চাকরি ফিরে পান। এভাবে বিভিন্নজনকে চাকরি থেকে হঠাৎ অবসরে পাঠিয়ে বিসিএসআইআরে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেন ফারুক আহমেদ।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে চেয়ারম্যান ফারুক তার আত্মীয় ও পরিবারের কমপক্ষে ৪৯ জনকে বিসিএসআইআরে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের অনেকের চাকরির বয়স এক বছর না হওয়া সত্বেও রাজধানীর ধানম-িসহ বিভিন্ন আবাসিক কোয়ার্টারে বাসা বরাদ্দ দিয়েছেন। অথচ ১০-১৫ বছর চাকরি করেও অনেকে বাসা বরাদ্দ পাননি।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগ অনুযায়ী, বিসিএসআইআরের দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের ২৩০ কোটি টাকা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সেন্টার ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয় ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন ফারুক আহমেদ। তিনি কৌশলে সায়েন্স ল্যাবের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেন। জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী (সিএসও) না থাকলে পিএসও থেকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেতেন। তিনি সেই নিয়ম ভেঙে অধস্তন বিজ্ঞানীদের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের ওপর পরিচালকের পদে বসান। তিনি সিএসও, গ্রেড-৩-এর ড. সারোয়ার জাহানকে পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে তারই অধস্তন সিএসও গ্রেড-৪-এর ড. সামিনা আহমেদকে পরিচালকের পদে বসান। এমনকি তৃতীয় গ্রেডের বিজ্ঞানী থাকা সত্ত্বেও ষষ্ঠ গ্রেডের অধস্তন বিজ্ঞানীকে দ্বিতীয় গ্রেড পদমর্যাদার পরিচালকের পদে বসিয়েছেন। বর্তমানে ১০ জন পরিচালকের (২য় গ্রেড) মধ্যে তিনজন চতুর্থ গ্রেডের বিজ্ঞানী কর্মরত আছেন। তিনি তৃতীয় গ্রেড পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের এসিআর লেখাতেন চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা দিয়ে। অধস্তন এসব কর্মকর্তার বিধিবহির্ভূত সুবিধা দিয়ে তার দুর্নীতির পথ সুগম রাখতেন।
প্রাপ্ত অভিযোগমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সায়েন্স ল্যাবরেটরির নবনির্মিত সেন্ট্রাল ল্যাবে অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি শুধু দুর্নীতির উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছে। এর মধ্যে মাল্টিডায়মেনশনাল জিসি-এইচপিএলসি-এমএস, এলসি-এমএস-এমএস, জেনেটিক এনালাইজার, রমন স্পেকট্রোমিটারসহ বহু যন্ত্র অস্বাভাবিক দামে কেনা হয়েছে। একটি মাল্টিডায়মেনশনাল জিসি-এইচপিএলসি-এমএস যন্ত্রের প্রচলিত বাজারদর ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে সায়েন্স ল্যাবের জন্য সেটি কেনা হয়েছে ৪ কোটির বেশি টাকা দিয়ে। যদিও মূল্য প্রাক্কলন কমিটি যন্ত্রটির দাম সুপারিশ করেছিল ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু দরপত্র খোলার পর দেখা যায় সেটির দর ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বেশি। দর প্রাক্কলন কমিটির দুই সদস্য চেয়ারম্যানের নির্দেশমতো কাজ না করায় তাদের ঢাকার বাইরে বদলি করে দেওয়া হয়। পরে চাপের মুখে চেয়ারম্যানের কথামতো কাজ করতে রাজি হলে তাৎক্ষণিক তাদের বদলি আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ঢাকার সেন্ট্রাল ল্যাবের জন্য এলসি-এমএস-এমএসওয়ান যন্ত্র কেনা হয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়। অথচ যন্ত্রটির বাজারদর ৮০ লাখ টাকার বেশি নয়। সায়েন্স ল্যাবের জন্য যে যন্ত্রটি কেনা হয়েছে সেটি ২০ বছরের পুরনো। এছাড়া রমন স্পেকট্রোমিটার কেনায়ও তিনি মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছেন। যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়ই শুধু নয়, যন্ত্রপাতির ওপর কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের নামেও ফারুক আহমেদ সায়েন্স ল্যাবের বিপুল অর্থের অপচয় ও আত্মসাৎ করেছেন জানিয়ে অভিযোগে বলা হয়, তার এসব দুর্নীতিতে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের দফায় দফায় বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে পাঠিয়েছেন। একজন উপসচিবকে একটি জিসিএমএস যন্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য জাপান ও সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছেন। অথচ ওই উপসচিব এ যন্ত্রের পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। যারা যন্ত্রগুলো পরিচালনা করবে, তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এসব যন্ত্র পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গবেষণাগারে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ থেকে ’১৯ সালে অনেকগুলো ১০০ কিলোওয়াটের জেনারেটর কেনা হয়। এসব জেনারেটর কেনায় সায়েন্স ল্যাবের বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। জেনারেটর কেনার জন্য প্রিইন্সপেকশনের নামে ফারুক আহমেদ তার দুর্নীতির সহযোগীদের যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমানে তেলের অভাবে না চালানোর কারণে জেনারেটরগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। সায়েন্স ল্যাব থেকে বিদায় নেওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে ফারুক আহমেদ চট্টগ্রামের একটি কলেজ থেকে পাস করা ও মালয়েশিয়ার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া আবদুস সালামকে নিয়োগ দেন। এমন তথ্য জানিয়ে দুদকে করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী কেমিক্যাল প্লান্ট ডিজাইনে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও সালামকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (গ্রেড-৩) পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তিনি সায়েন্স ল্যাবের অন্তত ১৫০ জন বিজ্ঞানীর জুনিয়র। এতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।