শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি

প্রকাশিত: ০৪:২১ এএম, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। দীর্ঘদিনেও নির্ধারণ হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা, সরকারের কাছে নেই প্রকৃত সংখ্যা। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তালিকা তৈরি করতে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুধু ঘটা করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর পালন করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দালিলিক কাজ কিছুই হয়নি। রোববার কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাচাই শেষে কমিটির আগামী বৈঠকে অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে। বৈঠকের তারিখ এখনও নির্ধারণ হয়নি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক রোববার বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। রোববার কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা ও ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। দুই তালিকা মিলে মোট এক হাজার ২২২ জন হয়, সেই তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন আবেদন আমাদের কাছে আছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও আবেদন আসবে, সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হবে। বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা, তার সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন তার আউটলাইন ঠিক হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা ঠিক করার পর যাচাই-বাছাই কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা এখনও নির্ধারণ হয়নি। আমরা সরাসরি এখান (কমিটি) থেকেই করব, নাকি জেলা-উপজেলাভিত্তিক কমিটির প্রয়োজন হবে, সেগুলো আগামী সভায় নির্ধারণ হবে।’ মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ছক কষে ঘাতকরা। তারা এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় এসব সূর্যসন্তানের তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য ২৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির সদস্যরা হলেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শহীদুল হক ভূঞা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. চৌধুরী শহীদ কাদের, নিপসমের পরিচালক ড. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে সদস্য হিসেবে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির, বীরপ্রতীক। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রথীন্দ্র নাথ দত্তকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম যাচাই-বাছাই, পিতার নাম ও ঠিকানাসহ তালিকা দেবে এ কমিটি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকা কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। এছাড়া কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, জেলা, উপজেলা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত ব্যক্তি-ব্যক্তিদের আবেদন যাচাই-বাছাই করবে ও শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করবে। রোববার কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক। বৈঠক শেষে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘এক হাজার ২২২ জনের প্রাথমিক তালিকা ১৯৭২ সালে প্রকাশ হয়েছিল। সেটা আমাদের হাতে এসেছে। এই তালিকা চলমান থাকবে। নতুন সংযোজন শেষে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করব। দীর্ঘদিন চলে গেছে, আর সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। বেইজলাইন হিসেবে ধরে নিয়েছি বাংলা একাডেমির একটা সংজ্ঞা আছে, বাংলাপিডিয়ার একটা সংজ্ঞা আছে, এই দুটোর সমন্বয় করে, আজকেও কিছু আলোচনা হয়েছে, সেগুলো কম্পাইল করে নতুন সংজ্ঞা আগামী সভায় পেশ করা হবে। এরপর সেটা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।’ বৈঠক শেষে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জানান, ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কাল ধরে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করা হবে। দেরিতে হলেও এই সরকার তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ডাক বিভাগ স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে, আরও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তালিকা হয়েছে। কিছু বেসরকারি উদ্যোগেও গবেষণা হয়েছে, সবগুলো আমাদের সংগ্রহে আনতে হবে। সরকারি তালিকা মন্ত্রণালয়ে আছে, বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো কাজ হয়েছে, সেই তালিকাগুলো হাতে পেতে হবে। তারা (আগের তালিকা প্রণয়নের সময়) যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এর বাইরেও নতুন কিছু এখানে যুক্ত করা যায় কিনা, সে বিষয়ে আজকে সভায় আলোচনা হয়েছে। আগামী সভায় এটা কংক্রিট চেহারা নেবে। জহির রায়হানকে বিএনপি-জামায়াত সরকার কোনো তালিকায় রাখেনি। কারণ তিনি ১৬ ডিসেম্বরের পর শহীদ হয়েছেন। ফলে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা সব সময় বলেছে জহির রায়হানকে আওয়ামী লীগ হত্যা করেছে। আমরা আজকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তালিকা করা হবে। মিরপুর মুক্ত দিবস অন্তর্ভুক্ত না করলে জহির রায়হান সেখানে থাকেন না। এটা তো বাস্তবতা যে, ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর শত্রুকবলিত ছিল। মিরপুর ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন। বুদ্ধিবীজীদের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত রোববার বলেন, ‘কমিটির বৈঠকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের তালিকা আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাচাই শেষে কমিটির আগামী বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা অনুমোদনের পর তালিকা প্রকাশ করা হবে।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই শেষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দেয়া হবে। ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, আশা করি আগামী জুলাইয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাব। জেলা পর্যায় থেকে তালিকা সংগ্রহের কাজ চলছে, আগামী জুলাইয়ে এর গেজেট হবে। এরও আগে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা মন্ত্রণালয়ে নেই। তবে সঠিক তালিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জুনের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশ করা হবে।’ কিন্তু এর কোনো অগ্রগতি নেই বলে নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা। তারা জানান, দেশের সব জেলা প্রশাসন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ ও লালন করে তাদের মাধ্যমে জেলাভিত্তিক তালিকা সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সব জেলা প্রশাসন তাদের তালিকা পাঠায়নি। কিছু জেলা থেকে নামের তালিকা এলেও ওইসব নামের বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় গণহারে নিহত ব্যক্তির নামও রয়েছে। এ কারণে বিষয়টির কোনো অগ্রগতি নেই। জানা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা শুরু করে। তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করে। সে অনুযায়ী ১১ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের আটক করা। তাদের হাত-পা-চোখ বেঁধে গোপন স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে তাদের মরদেহ ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আবর্জনার মধ্যে ফেলে রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর বুদ্ধিজীবীদের নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার স্বজনের লাশ খুঁজে পান। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মতান্তরে ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
Link copied!