শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

লোপাট ১৫শ কোটি টাকা!

প্রকাশিত: ০৫:৪৪ এএম, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১

লোপাট ১৫শ কোটি টাকা!

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) বর্তমান পরিচালকদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক (ইডি) শাহ আলমের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছেন আমানতকারীরা। প্রায় দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রধান বিচারপতি, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠানে লিখিত আকারে এ অভিযোগ দেয়া হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ৭৬ জন আমানত ও বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। আরও জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৮ জুলাইয়ে দেয়া উল্লিখিত লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ‘পিপলস লিজিংয়ের নেপথ্যে এবং প্রকাশ্যে যেসব দুর্নীতিবাজ এ মহাদুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারা হচ্ছেন- রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার, পিএলএফএসএলের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সাবেক এমডি ড. ইউসুফ খান, বর্তমান এমডি সামি হুদা, শেখর কুমার হালদার, সুকুমার মৃধা, অমিতাভ অধিকারী ও কাজী আহমেদ জামাল। এরা সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমের ছত্রছায়ায় অবৈধ ও দুর্নীতির মূল কাজগুলো করেন। এ একই ব্যক্তিরা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) প্রভৃতি কোম্পানির পরিচালক হিসাবে বহাল আছেন, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের পরিপন্থি।’ ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৮ সালের শুরু থেকে নিয়মিতভাবে চেক ডিজঅনার, মুনাফা প্রদানে বিলম্ব এবং আমানত নগদায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হতে থাকে পিপলস লিজিং। ফলে অফিসে পাওনা টাকার জন্য দলে দলে ভিড় করতে থাকেন গ্রাহকরা। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিতে ঝগড়াঝাটি ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। এর আগে ২০১৩ সালে পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসেন। ইতঃপূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু অনিয়মিত ঋণ প্রদানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন তিনি, এতে কোম্পানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছিল। তখন পিএলএফএসের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় পরিচালনা পর্ষদে ন্যক্কারজনক পরিবর্তন ঘটে এবং নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে সমাজে অপরিচিত, দুর্নীতিবাজ এবং বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে কোম্পানি থেকে অভিজ্ঞ যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করেই অন্যায়ভাবে ক্রমাগত ছাঁটাই করতে থাকে। পাশাপাশি যোগ্যতা, গুণাগুণ, সততা ও অভিজ্ঞতার বিচার না করে উচ্চপদস্থ পদে তাদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দিতে থাকে। যারা নতুন পরিচালকদের অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন।’ বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু পিপলস লিজিংয়ে ছিলেন ৫ থেকে ৬ জন স্বতন্ত্র পরিচালক, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। আমানতকারীদের চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত প্রলোভনমূলক স্থায়ী আমানত (এফডিআর) স্কিমের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে পিপলস লিজিং। এছাড়া প্রথম থেকে যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তা থেকেও ২০১৫-১৯ সাল পর্যন্ত ৬০০ কোটি টাকার বেশি আদায় করা হয়। এ সময়ের মধ্যে কোম্পানিটি বিনিয়োগ করেছে মাত্র ১২৬ কোটি টাকা। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির বিভিন্ন স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এছাড়া কোম্পানির শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে গ্রাহকের মার্জিন ঋণের বিপরীতে ৩৫০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে সে অর্থ কুক্ষিগত করে। অর্থাৎ ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে বিনিয়োগ করে মাত্র ১২৬ কোটি, তাও নতুন পরিচালকদের নিজস্ব কোম্পানিতে। উল্লিখিত কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় উচ্চপদস্থ অসাধু কর্মকর্তা বিশেষত মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমের যোগসাজশে অতি স্বল্প সময়ে গোপনীয়তা বজায় রেখে পিএলএফএসকে অবসায়িত করে বিশাল দুর্নীতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পিপলস লিজিংয়ের পর্ষদ ভেঙে দিলে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং নির্বাহী পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠান তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন। চিঠিতে জানানো হয়, পিপলস লিজিংয়ের উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানের তিনজন নতুন পরিচালক হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উজ্জ্বল কুমার নন্দী, ওরিক্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নং চাও মং এবং ড্রাইনুন অ্যাপারেলস লিমিটেডের কাজী মোমরেজ। কিন্তু পরিচালক হওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল তা সঠিকভাবে দাখিল করতে পারেননি তারা। এছাড়া পরিচালক হতে প্রয়োজনীয় শর্তাদি পূরণে ব্যর্থ হন তারা। আবেদনকারী তিনজনের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তারপরও একই বছরের ১২ অক্টোবর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের নতুন পরিচালক নিয়োগ প্রসঙ্গে একটি চিঠি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এবং ড্রাইনুন অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রস্তাবিত প্রতিনিধিদের পর্ষদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অনাপত্তি জ্ঞাপন করা যাচ্ছে। অথচ আগেই তাদের অযোগ্য ঘোষণা করে পিপলস লিজিং কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ পিপলসের আপত্তি আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘যে অভিযোগ করেছে তা আমার জানা নেই। আমি চিঠিও পাইনি।’ ৪ ফেব্রুয়ারি এক অফিশিয়াল আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, পিকে হালদারের অপকর্মের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম জড়িত ছিলেন। এর ভিত্তিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তখন তাদের বিরুদ্ধে স্টাফ ‘ল’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।
Link copied!