করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপন্ন-বিপর্যস্ত বিশ্বে আবার এসেছে বাঙালির নববর্ষ। আজ বুধবার পহেলা বৈশাখ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঙালিরা করোনা মহামারি থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় নতুন বছরকে বরণ করে নেবে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। দেশে একই দিনে শুরু হয়েছে মুসলিম বিশ্বের সিয়াম সাধনার মাস রমজান। আর করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আজ ১৪ এপ্রিল থেকেই দেশে শুরু হয়েছে আট দিন পর্যন্ত চলাচলের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ।
নববর্ষের দোলায় আর মুসলিমদের আত্মসংযমের সাধনায় আজ ভোরের প্রথম সূর্যের আলো রাঙিয়ে দেবে যে নতুন স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন স্বাভাবিকভাবেই করোনাভাইরাসমুক্ত নতুন দিনের। নতুন সম্ভাবনার।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের আর মনের মিলন ঘটার দিন। শুভ দিনের বারতা নিয়ে আসে এই দিন। কিন্তু এই পহেলা বৈশাখেই মহামারি থেকে বাঁচার আকুতি নিয়ে এসেছে বিচ্ছিন্নতার ডাক, তথা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান। কঠোরভাবে তা অনুসরণের জন্য আজ থেকে সারা দেশে শুরু হচ্ছে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
আজ পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে ওঠার কথা বাঙালির। রাজধানীজুড়ে থাকার কথা মঙ্গল শোভাযাত্রা আর বর্ষবরণের নানা আয়োজন, কিন্তু পৃথিবী এখন এক অনিশ্চিত যাত্রায়। অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে সারা বিশ্ব। মৃত্যু হানা দিচ্ছে ঘরে ঘরে। গতকাল মঙ্গলবারও দেশে মারা গেছে ৬৯ জন, আগের দিন মারা গেছে ৮৩ জন। গতকাল পর্যন্ত গত এক বছরে দেশে মারা গেছে ৯ হাজার ৮৯১ জন। আর সারা বিশ্বে মারা গেছে ২৯ লাখ ৬২ হাজার ১৫৫ জন। গত বছর থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। তাই গত বছরের মতো এবারও দেশজুড়ে বৈশাখ বরণে মেতে উঠবে না জাতি। রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছড়াবে না কোনো সুর। কোথাও বাজবে না ঢাক-ঢোল। বসবে না বাহারি পণ্যের মেলা।
বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকোর তালিকায় স্থান পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হবে না হালখাতা উৎসব। কিন্তু তার পরও সবার মনে ঠিকই গুঞ্জরিত হবে পহেলা বৈশাখের সেই চিরায়ত গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ একই সঙ্গে এবারের বৈশাখের আবাহন হয়ে উঠবে, ‘ওরে আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’। এবারের বৈশাখে নিজেকে ঘরে আবদ্ধ রেখে আর সবাইকে সুস্থ রাখার কথা উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে।
আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও ঘরে বসে যে যার মতো করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে। ছায়ানটের বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতি অনুষ্ঠান ধারণ করে আজ ভোরে বিটিভিতে প্রচার করা হবে। টেলিভিশনগুলোও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বছর শুরুর দিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানরা। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষেও বিভিন্ন দলের নেতারা দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘এ বছর এমন একটা সময়ে বাংলা নববর্ষের দিনটি অতিবাহিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত। তাই এখন সবারই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে দেশ ও দেশের জনগণকে করোনার ছোবল থেকে রক্ষা করা। সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে সবার মাস্কসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।’
গতকাল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে বিধি-নিষেধ মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোনোভাবেই সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাই আমাদের আরো কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। আমি জানি, এর ফলে অনেকেরই জীবন-জীবিকায় অসুবিধা হবে। কিন্তু আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন সর্বাগ্রে। বেঁচে থাকলে আবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে পারব।’ তিনি দেশবাসীকে পবিত্র মাহে রমজানের মোবারকবাদ ও পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানান।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিশ্বের সব মুসলমানকে শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানান।
আজ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন কার্যকর করতে সরকার ১৩ দফা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। ‘অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা, চিকিৎসাসেবা, মরদেহ দাফন বা সৎকার এবং টিকা কার্ড নিয়ে টিকার জন্য যাওয়া) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশব্যাপী সর্বাত্মক বিধি-নিষেধ শুরুর দিনেই শুরু হয়েছে রমজান মাস। রমজান সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং রমজানের সংযম শিক্ষা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সুফল নিয়ে আসবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, একই দিনে বাঙালির নববর্ষ, মুসলমানদের রমজান ও ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হওয়ার মধ্যে বিশেষ তৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলা বর্ষবরণ বাংলাদেশের সব মানুষের একটি সর্বজনীন উৎসব। অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এর সুর উদযাপনের, আনন্দের। সবার সঙ্গে সবার মিলনের, কিন্তু মানুষ তো মিশতে পারছে না। মানুষের জীবন এখন বিপন্ন, বিপর্যস্ত। কিন্তু কালবৈশাখীর একটি শিক্ষা হচ্ছে—ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পরেও ঘুরে দাঁড়ানো। আমি আশা করব, এই বৈশাখে এই চেতনাকে মানুষ গ্রহণ করবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে।’
মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘রমজান হচ্ছে সংযমের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। একটি বড় শিক্ষা রমজান দেয়, সবাইকে নিয়েই এই মাসটা উদযাপন করতে হয়। ব্যক্তিগত দিক হলো, আত্মশুদ্ধির সাধনা আর সমাজগত দিক হলো, সবার সঙ্গে সবাইকে মেলাতে হবে। সারা দিন উপবাসের মধ্যে দিয়ে ক্ষুধাপীড়িতদের জন্য সমবেদনা তৈরি হয়। আশা করি, রমজানের এই বাণী আমরা গ্রহণ করব। নিরন্ন মানুষের জীবনেও যেন ঈদের আনন্দ আসে, সেই বিষয়ের প্রতিও যেন খেয়াল রাখি। আর সরকারের লকডাউনটাও যেন যথাযথভাবে কার্যকর হয়, সেটাই চাইব। কারণ নিজেকে বাঁচতে হবে, অন্যকেও বাঁচাতে হবে। সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, ত্যাগ স্বীকারটা যেন করি, শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনে করেন, একদিকে করোনাভাইরাস অন্যদিকে হেফাজতি সন্ত্রাসের বিস্তার সারা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ অবস্থায় মাহে রমজান ও বাংলা নববর্ষ উভয়ই এই দুই বিপদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে দেশ থেকে। রমজানে মানুষের চিত্ত হোক শুদ্ধ। আর বৈশাখী ঝড় করোনাভাইরাসকে উড়িয়ে নিয়ে যাক। শুচি হোক ধরা।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, ‘পরম করুণাময়ের ইবাদতে আমরা সংযম, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা লাভ করি। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার ভুলে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় মাহে রমজান আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। এই শিক্ষা করোনা মহামারি প্রতিরোধেও ইতিবাচক সুফল নিয়ে আসবে।’ তিনি পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসীকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানান।