শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

মালেকের সিন্ডিকেটে আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠরা

প্রকাশিত: ০৩:০৪ এএম, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০

মালেকের সিন্ডিকেটে আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠরা

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভার ওরফে বাদল হাজি স্বাস্থ্য বিভাগে তদবির বাণিজ্য করার জন্য এক ডজন গাড়িচালককে কাজে লাগিয়েছেন, যাঁদের ছয়জন তাঁর আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাবেক ডিজিসহ কয়েকজন পরিচালক এবং নিম্নপদের বেশ কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার তথ্য মিলেছে। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলছেন না চতুর মালেক। অসুস্থতার কথা বলে চুপসে থাকা মালেক দাবি করছেন, তাঁর সম্পদের বেশির ভাগই পারিবারিক। তবে আয়কর রিটার্নে মালেক শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করে মাত্র দুই কোটি টাকার সম্পদের বিবরণী দিয়েছেন। সেই দুই কোটিরও বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি তিনি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্ত্রী নার্গিস বেগম ও আত্মীয়-স্বজনের নামেই বেশি সম্পদ গড়েছেন মালেক। এদিকে মালেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের দায় নিতে চাইছে না স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। গত বুধবার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘অভিযোগের দায় মালেকের ব্যক্তিগত। এছাড়া অধিদপ্তরে কোনো পরিবহন পুল নেই।’ জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মালেক ড্রাইভারের ব্যাপারে ছায়া তদন্ত বা অনুসন্ধান করেই আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁর ফৌজদারি অপরাধই আমাদের কাছে মুখ্য। বাকি যেসব প্রাথমিক তথ্য, সেগুলো সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা চাইলে সরবরাহ করব।’ গতকাল বৃহস্পতিবার মালেককে তৃতীয় দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তুরাগ থানার পুলিশ। জানতে চাইলে তুরাগ থানার পরিদর্শক (ওসির দায়িত্বে) বলেন, ‘এজাহারের অভিযোগগুলো আমরা যাচাই করছি। এখনো অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’ তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মালেক নিজেকে নিরপরাধ দাবি করছেন। শতকোটি টাকার সম্পদ পারিবারিক বলে জানাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন—এ কথা বলেও সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তদন্তকারীরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন আলামত যাচাই করে দেখছেন। র‌্যাব পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়ার কারণে মালেক অনেক গাড়িচালককে দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজ করিয়ে নিতেন। তবে এক ডজন চালক তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ। ভাগ্নে সোহেল ওরফে ‘সোহেল শিকারি’ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে উপপরিচালকের (প্রশাসন) গাড়ি চালান সোহেল। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। মালেকের ভায়রা মাহবুব হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহায়ক ছিলেন। তদবির করে তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে গাড়িচালক পদে বসানো হয়। তবে তিনি এক দিনও গাড়ি নিয়ে বের হননি। বর্তমানে তাঁর পোস্টিং অধিদপ্তরের এনসিডিসি শাখায়। বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগে মাহবুব সহায়তা করতেন মালেককে। তাঁর আরেক ঘনিষ্ঠ শাহজাহান ড্রাইভার। বর্তমানে তিনি পরিচালকের (অর্থ) গাড়ি চালান। আরেক গাড়িচালক মাইনুল হোসেন গাজীপুরে বাড়ি ও গাড়ি বেচাকেনার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। মেডিক্যাল এডুকেশন শাখার অতিরিক্ত মহাপরিচালকের গাড়িচালক রফিকুল ইসলাম ওরফে জামালও মালেকের আস্থাভাজন। মিলেমিশে কাজ করেছেন। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে পাঁচতলা বাড়ি ও জুতার কারখানা আছে জামালের। অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী নাসরিন আক্তার ২০০৪ সালে মালেকের মাধ্যমেই চাকরি পান বলে জানা গেছে। একই চেয়ারে ১৭ বছর ধরে বসে মালেকের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছেন তিনি। অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক আবদুল মতিন মালেকের তদবির সিন্ডিকেটে ঘনিষ্ঠ হয়ে কোটিপতি হয়ে গেছেন বলে জানায় সূত্র। সূত্র মতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি অধ্যাপক শাহ মুনীর হোসেন ও আবুল কালাম আজাদের পর আরেক ডিজির সঙ্গেও মালেকের ঘনিষ্ঠতার তথ্য মিলেছে। মিজানুর রহমান নামে ওই ডিজির সময় সবচেয়ে বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন মালেক। সাবেক দুই পরিচালক খাজা আব্দুল গফুর ও মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ছিল মালেকের ঘনিষ্ঠতা। উপজেলা পর্যায় এবং স্বাস্থ্য সহকারী কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি পদে নিয়োগে সবচেয়ে বেশি তদবির করেন মালেক। এ ছাড়া বদলি, পদোন্নতি এবং ঠিকাদারি কাজেও তদবির করে তাঁর সিন্ডিকেট। দুই কোটি টাকারও হিসাব দিতে পারেননি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাড়ি, জমি ও খামার পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করলেও আয়কর রিটার্নে মালেক ড্রাইভার এগুলো গোপন রেখে মাত্র দুই কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন। আয়কর রিটার্নের তথ্য যাচাইয়ে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ সালে মালেক ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদ দুই কোটি ৩০ লাখ ৯৯ হাজার টাকার। পারিবারিক ব্যয় ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। অথচ তিনি ও তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগমের আয় দেখান ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাকি এক কোটি ৮৫ লাখ টাকার কোনো বৈধ উৎস তিনি দেখাতে পারেননি। তাঁর হাতিরপুল এলাকায় নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের কাজ স্থগিত আছে আদালতের হস্তক্ষেপে। মেয়ের নামে রয়েছে ১৫ কাঠার ওপর ডেইরি ফার্ম। এ ছাড়া আরেক স্ত্রীর সম্পদের বিবরণীই দাখিল করেননি তিনি। সম্পদের বেশির ভাগই পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করেন মালেক। দায় নেই বর্তমান অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ?শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীনে গত বছরের ২৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর গঠিত হয়। বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন সে বছরের ৩১ ডিসেম্বর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। গাড়িচালক আব্দুল মালেককে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আজ পর্যন্ত নবগঠিত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কোনো প্রকার কেনাকাটা, কর্মচারী নিয়োগ, পদায়ন বা পদোন্নতির কাজ করা হয়নি। কাজেই গাড়িচালক আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই।’ প্রসঙ্গত, গত রবিবার রাতে রাজধানীর তুরাগের কামারপাড়ার ৪২ নম্বর বামনের টেকের বাড়ি ‘হাজী কমপ্লেক্স’ থেকে মালেককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং দেড় লাখ জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তুরাগ থানায় দুটি মামলা করা হয়। সোমবার মালেককে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই দিনই তাঁর ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মাত্র ২৬ হাজার টাকার বেতনের কর্মচারী হয়ে রাজধানীতে দুটি বহুতল ভবন, প্রায় ২০ কাঠা জমির মালিক, গরুর খামার ও নামে-বেনামে ব্যাংকে টাকাসহ শতকোটি টাকার সম্পদ মালেকের। এসব অভিযোগে এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন মালেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
Link copied!