শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বরখাস্ত এস আই আকবর লাপাত্তা

প্রকাশিত: ০৪:২০ এএম, অক্টোবর ১৪, ২০২০

বরখাস্ত এস আই আকবর লাপাত্তা

পুলিশ ফাঁড়িতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে সিলেটে। গতকাল দিনভর ফাঁড়ি ঘেরাও, রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে সিলেটের মানুষ। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি কাউকে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া গতকাল দুপুরের পর থেকে লাপাত্তা। খোদ কর্মকর্তারাই তার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। অন্যরাও গাঢাকা দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মামলাটির তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আজ পিবিআইয়ের এই মামলার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে। সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের হয়রানি, নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে মারধর, মাদক ও জুয়া, অসামাজিক কার্যকলাপের শেল্টার দেয়া, ছিনতাইকারী পোষাসহ নানা অভিযোগ এই ফাঁড়ির পুলিশের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ অতীতে উত্থাপিত হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব-ইন্সপেক্টর আকবর হোসেন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে নানা অপকর্মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিলো এই ফাঁড়িকে। অভিযোগ থাকলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন নীরব। সবশেষ গত শনিবার রাতে সিলেট নগরীর নেহারীপাড়ার যুবক রায়হান উদ্দিনকে ফাঁড়িতে ধরে এনে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তের আলোকে এসআই আকবরসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয়েছে। আর পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পিবিআইয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এখন মামলার তদন্ত করবে পিবিআই। তবে গতরাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়নি বলে জানান তিনি। পুলিশ ফাঁড়িতে নিহতের ঘটনায় রায়হানের পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে ছুটছেন সবাই। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুক উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদউদ্দিন আহমদ, কামরানপুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিহত রায়হানের বাসায় যান। তারা সমবেদনা জানাতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হন। কারণ একটি ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে গোটা সংসার। এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন মেয়র আরিফ। আর আওয়ামী লীগ নেতা জানান, সিলেট-১ আসনের এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ঘটনার বিচারে সোচ্চার। তিনি পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু হয় সিলেটে। দুপুরে সিলেটের কাজিরবাজার মাদ্রাসার পক্ষ থেকে ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় মিছিল বের করা হয়। জেলা পরিষদের সামনে তারা মানববন্ধন করে। এরপর সাধারণ ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ করা হয়। তারা ফাঁড়ি ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা ফাঁড়ির সামনে ব্যস্ততম রাস্তায় অবস্থান নেন। তারা এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই আকবরসহ পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। রাস্তা অবরোধ করে রাখায় বন্দরবাজার এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকালে লালদিঘীরপাড় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকা অবরোধ করে রাখা হয়। এ সময় ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িও অবরোধ করে রাখে বিক্ষোভকারীরা। পরে তারা কালেক্টরেট মসজিদের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। এদিকে মদিনা মার্কেট এলাকায় চার ওয়ার্ডবাসীর পক্ষ থেকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দোষীদের গ্রেপ্তার না করলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। পরে সিলেট নাগরিকবৃন্দের পক্ষ থেকে কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি ও সমাবেশ করা হয়। বিকালে উত্তপ্ত ছিল সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা। ছাত্রলীগের শহীদ নুর হোসেন ব্লকের পক্ষ থেকে ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নিহত রায়হানের মামা অভিযোগ করেন ঘটনার সান্ত্বনা জানাতে সিলেটের মেয়রসহ রাজনৈতিক নেতারা নিহত রায়হানের বাড়িতে ছুটে গেলেও পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এখনো যাননি। এতেই বোঝা যায় এই প্রশাসন সরকারকে বিতর্কিত করতে কাজ করছে। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি সুজনের: সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যুবককে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। মঙ্গলবার নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন- রায়হান উদ্দিনকে অন্যায়ভাবে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যা এখন পরিষ্কার। এই বর্বর নির্যাতন ১৯৭১ সালের পাক হানাদারদের নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় যাদেরকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদেরকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। শান্ত সিলেটে খুনি প্রদীপের প্রেতাত্মাদের স্থান হবে না-মুসা: হযরত শাহজালাল ও শাহপরাণ (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত শান্তি ও সমপ্রীতির শহর সিলেটের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার পাঁয়তারা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তায় যারা নিয়োজিত তাদের হাতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নেই। প্রশাসন যদি রায়হান হত্যায় জড়িতদের শাস্তি নিয়ে কোনো টালবাহানা করে, তাহলে সিলেটবাসী বৃহৎ আন্দোলন ডাক দেবে। দুপুরে জেলা পরিষদে সম্মুখে নগরীর নেহারিপাড়ার নিরীহ রায়হানকে পুলিশের হেফাজতে নৃশংস অমানবিক নির্যাতনে খুন হওয়া রায়হান হত্যার জড়িত পুলিশদের শাস্তির দাবিতে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান (রহ.) প্রজন্ম আয়োজিত মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের আহ্বায়ক ও জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার সিলেটের প্রিন্সিপাল মাওলানা সামীউর রহমান মুসা এ কথা বলেন। মাওলানা ফাহাদ আমানের পরিচালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জামেয়া মাদানিয়া প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের সভাপতি হাফিজ মাওলানা সৈয়দ শামীম আহমদ, প্রজন্মের সদস্য সচিব ও জামেয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ, মাওলানা তাজুল ইসলাম হাসান, জামেয়া তালিমুল কোরআনের প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমদাদুল হক নোমানী, জামেয়া মাদানিয়ার সহকারী শিক্ষা সচিব মাওলানা মুশফিকুর রহমান মামুন, হাফিজ আব্দুল কাইয়ুম, মাওলানা হাফিজ ফয়জুল ইসলাম, মাওলানা বেলাল আহমদ চৌধুরী, মাওলানা আমিন আহমদ রাজু, সুফিয়ান বিন এনাম, ইকরামুল হক জুনেদ, তানজিল আহমদ, হাফিজ কয়েস আহমদ, আব্বাস উদ্দিন জালালি প্রমুখ। সিলেট নাগরিকবৃন্দের দাবি: সিলেট বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে বর্বরোচিত নির্যাতনে রায়হান হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সিলেটে নাগরিকবৃন্দের উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম। বাসদ জেলা সদস্য প্রণব জ্যোতি পালের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নিহত রায়হানের ভাই রাব্বি আহমেদ তানভীর, গণফোরাম জেলা সভাপতি আনসার খান, বাসদ মার্কসবাদী জেলা আহ্বায়ক উজ্জ্বল রায়, বাসদ সিলেট জেলার সমন্বয়ক আবু জাফর, সিলেট জেলার আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক সেলিম, বাসদ মার্কসবাদী পাঠচক্র ফোরাম জেলা সমন্বয়ক সুশান্ত সিনহা সুমন প্রমুখ।
Link copied!