শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাদ দিয়েই কমিটি!

প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০

প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাদ দিয়েই কমিটি!

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরোধ চরমে উঠেছে। বেশির ভাগ জেলা ও মহানগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা তাঁদের পছন্দমতো নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করে অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। এসব কমিটিতে সম্মেলনের সময় যাঁরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাঁদের বেশির ভাগকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার দুর্দিনে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন অনেক নেতাও বাদ পড়েছেন কমিটি থেকে। ফলে বেশ কয়েকটি জেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনের তথ্য পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা কেন্দ্রে জমা পড়া ২০টির মতো কমিটির বেশ কয়েকটি সংশ্লিষ্ট নেতাদের ফেরত দিয়ে সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি সপ্তাহখানেক আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পছন্দমতো লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে প্রয়োজনে সেসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন। জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে ৩১টি জেলা ও মহানগরে আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সাংগঠনিক জেলাগুলোতে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে তা কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেন। পরে ১৬ সেপ্টেম্বর সভাপতিমণ্ডলীর সভায় এ সময় আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। সে হিসাবে গতকাল মঙ্গলবার ছিল কমিটি জমা দেওয়ার শেষ দিন। তবে এখনো বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি জমা পড়েনি। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া জানিয়েছেন, সম্মেলন হওয়া ৩১ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের কমিটি কেন্দ্রে জমা পড়েছে। বাকি কমিটিগুলো আগামী ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভার আগেই জমা পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘জেলা ও মহানগর কমিটিগুলো নিয়ে এখনো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বসেনি। তবে বেশ কিছু কমিটি নিয়ে অভিযোগ ওঠায় সভাপতি শেখ হাসিনা সেসব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ফেরত দিয়েছেন। যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আছেন তাঁদের বলে দিয়েছেন সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে কমিটি গঠন করে আবার জমা দিতে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘স্বজনপ্রীতি ও নিজেদের লোক দিয়ে কমিটি দেওয়া হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা বাদ পড়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সবাইকে বলব সামনে যে কমিটিগুলো গঠন করা হবে, সেগুলোতে অবিতর্কিত এবং ত্যাগীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ তিনি গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় শেখ হাসিনাও পছন্দমতো লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে প্রয়োজনে জেলা ও মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেট জেলা ও মহানগর, রাজশাহী জেলা ও মহানগর, হবিগঞ্জসহ অন্তত ১৮-২০টি সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্দিনের নেতাদের বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমরান ফারুক মাসুমকে এবারের কমিটিতে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদে রাখা হয়েছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক যখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসেছিলেন আমি ঝুঁকি নিয়ে কালো পতাকা দেখিয়েছিলাম। আর এখন কমিটিতে নব্য আওয়ামী লীগারদের জয়জয়কার। আমাকে পদাবনতি দিয়ে অপমান করা হয়েছে।’ জানা গেছে, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে প্রয়াত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা রশিদী সুজার অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন মোখলেসুর রহমান, আশরাফুজ্জামান বাবুল, বি এম জাফর, মালিক সরোয়ারসহ বেশ কয়েকজন। জানা যায়, কক্সবাজার জেলা কমিটিতে বাদ পড়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ও সংসদ সদস্য জাফর আলমসহ তাঁর অনুসারীরা। আমাদের সিলেট অফিস জানায়, প্রায় ১৪ বছর পর গত বছরের ডিসেম্বরে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে পুরনো ও দুর্দিনের বেশ কয়েকজন নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো। এরই মধ্যে মহানগর কমিটির পদবঞ্চিত নেতারা পাল্টা একটি কমিটি কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। আর জেলার পদবঞ্চিতরাও আজ-কালের মধ্যে পাল্টা কমিটি কেন্দ্রে জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন। জানা গেছে, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুত্ফুর রহমান অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে দলীয় কর্মসূচিতে তুলনামূলক কম অংশগ্রহণ করেন। সে কারণে প্রথম সহসভাপতি পদ পেতে দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী কয়েস পদটি পেতে আগ্রহী ছিলেন। সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে সিলেট জেলার যে কমিটি পাঠানো হয়েছে তাতে স্থান পাননি ইমরান আহমদ। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা সৈয়দ আবু নছর ও শাহ মুদাব্বির আলীরও স্থান হয়নি কমিটিতে। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরী বলেন, ‘কেন্দ্রে জমা হওয়া পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ত্যাগীরা বাদ পড়েছেন। আগের কমিটির সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করা অনেকে বাদ পড়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের মতো ব্যক্তিকেও কমিটিতে রাখা হয়নি। এবার আমিও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ছিলাম। এ কারণে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমাকে অবমূল্যায়ন করেছেন।’ দু-এক দিনের মধ্যে কেন্দ্রে একটি পাল্টা কমিটি জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। দুর্দিনের নেতাদের বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিলেট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘আগের কমিটির কাউকেই বাদ দেওয়া হয়নি। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের জায়গা পূরণ করা হয়েছে। আমি যথাসম্ভব নিয়ম মেনে কমিটি করার চেষ্টা করেছি। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে।’ জানা গেছে, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির অনেক ত্যাগী নেতাকে প্রস্তাবিত কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে বিগত কমিটির সাবেক সহসভাপতি মফুর আলী, সিরাজুল ইসলাম, সিরাজ বক্স, মোশাররফ হোসেন, ফাহিম আনোয়ার চৌধুরী বাদ পড়েছেন। বিগত কমিটির কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন রানাকেও রাখা হয়নি বর্তমান কমিটিতে। বাদ পড়েছেন মিফতাউল ইসলাম সুইট, তুহিন কুমার দাস মিকন, শামসুল ইসলাম, জগদীশ দাস, প্রিন্স সদরুজ্জামান, আবরার আহমদ দুলাল, রাধিকা রঞ্জন রায় ও শাহানারা বেগম। বাদ পড়েছেন বিগত কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তপন মিত্রও। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম বলেন, ‘একপেশে একটি কমিটির তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। ওই কমিটিতে চাঁদাবাজ ও অনুপ্রবেশকারীরা রয়েছেন বলে আমরা জেনেছি। অতীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের আগে সবার মতামত নেওয়া হতো। এবার তা হয়নি।’ এ প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। কার্যকরী কমিটিতে ৭৫ জন ছাড়াও উপদেষ্টা কমিটিতে ২৭ এবং জাতীয় পরিষদে একজনকে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কমিটি করার চেষ্টা করেছি।’ আমাদের রাজশাহী অফিস জানায়, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত ১২ মার্চ রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ৭৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রের কাছে জমা দেওয়া হয়। তবে এই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি বিগত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কয়েকজনের। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, গত সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন রাজশাহীর সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান এবং সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন আব্দুল মজিদ সরদার। বিগত কমিটির এই দুই সহসভাপতিকে কমিটিতে রাখা হয়নি। বিগত কমিটির সহসভাপতি বদরুজ্জামান রবু, মকবুল হোসেন, সাবেক এমপি জিন্নাতুননেসা তালুকদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান চঞ্চলও বাদ পড়েছেন। আমাদের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এ কমিটির বিরুদ্ধে পাল্টা আরেকটি কমিটি গঠন করেছে জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ। বিক্ষুব্ধ ওই নেতারা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছে পৃথক আরেকটি জেলা কমিটি জমা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম মোল্লা মাসুম বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি দলের ত্যাগী অনেক নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পকেট কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। তাই আমরা প্রকৃত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমা দিয়েছি।’
Link copied!