সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন যুগে দক্ষিণ এশিয়া : প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৩:৪৯ এএম, মার্চ ১০, ২০২১

নতুন যুগে দক্ষিণ এশিয়া : প্রধানমন্ত্রী

খাগড়াছড়ির রামগড়ে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সেতুর মাধ্যমে দুই দেশ যুক্ত হলো। এই প্রথম সীমান্তের কোনো নদী সেতুর মাধ্যমে প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুই দেশের সরকারপ্রধান সেতুটি উদ্বোধন করেন। সেতু উদ্বোধনের ক্ষণটিকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভারতকে কানেক্টিভিটি (সংযুক্তি) দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। আমরা এমন একটি অঞ্চলে আছি, যেখানে কানেক্টিভিটি চালুর বিষয়ে রক্ষণশীল ছিল এবং যেখানে সম্ভাবনার চেয়ে আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্য অনেক কম। আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রে ভৌত বাধা হওয়া উচিত নয়।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর নয়, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারবে। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বই জোরদার করছে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করছে। পুরো ত্রিপুরা অঞ্চলকে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে বাণিজ্য করিডর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।’ ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরকে যুক্ত করেছে। সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরামসহ পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৬ জুন দুই প্রধানমন্ত্রী এ সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৩৩ কোটি রুপি ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করেছে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল)। এই সেতু থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে বন্দর থেকে ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল দুপুরে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সেতুটির উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে ত্রিপুরার সাবরুমে একটি ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টেরও ভিত্তি স্থাপন হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মৈত্রী সেতু উদ্বোধনসহ বেশ কিছু প্রকল্প উদ্বোধন করেন। আগে ধারণ করা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ওই ভিডিও কনফারেন্সে প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবও বক্তব্য দেন। মৈত্রী সেতু শুধু ভারতের সঙ্গে নয়; নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যকে সহজ করবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের জনগণকে ত্রিপুরাবাসীর আশ্রয়, সমর্থন ও সহযোগিতার কথাও স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ২০১০ সালে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য এই সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অনুরোধটি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় পক্ষকে সেতু নির্মাণে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১০ বছর পর আজকে এই সেতুটি একটি বাস্তবতা। এই সেতুটি উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য একটি বাণিজ্য ‘লাইফলাইন’ হবে। আপনারা সবাই জানেন, পণ্য পরিবহনের জন্য এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।” শেখ হাসিনা বলেন, ফেনী সেতু চালুর মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বের ‘ল্যান্ডলকড’ রাজ্যগুলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে পারে। আগে এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরে আগরতলার নিকটতম সমুদ্রবন্দর ছিল কলকাতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আগরতলার নিকটতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম। বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং এটি আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মৈত্রী সেতু ত্রিপুরা এবং আশপাশের ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি করবে বলে আশা করছি। আমরা আশা করি, মৈত্রী সেতুর আশপাশের এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের জীবন-জীবিকার উন্নতিতে অবদান রাখবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির গতিপথ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রতিবেশী করে তুলেছে। বৈশ্বিক টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম নেতা হিসেবে আমরা আমাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পথ তৈরি করেছি। বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কানেক্টিভিটির কেন্দ্র হিসেবে এর অবস্থানগত সুবিধা সর্বাধিক করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। মৈত্রী সেতুর সফল পরিচালনা এবং ব্যবহার প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মৈত্রী সেতু এমন একসময় উদ্বোধন করছি, যখন আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বর্ষ উদযাপন করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে ভারত বাংলাদেশের জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিল, আজকে আমরা একসঙ্গে সমৃদ্ধ অঞ্চল তৈরি করছি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, সাম্প্রতিক বছরে বাস্তবায়িত হওয়া রেল ও নদী পথে কানেক্টিভিটি উদ্যোগগুলো মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে আরো জোরালো হবে। এই সেতু বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে ত্রিপুরাসহ দক্ষিণ আসাম, মিজোরাম ও মণিপুরের কানেক্টিভিটি জোরদার করবে। মৈত্রী সেতু বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক সুযোগ ত্বরান্বিত করবে বলে মোদি জানান। মৈত্রী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানান। মোদি বলেন, তিনি তাঁর বাংলাদেশ সফরের সময় ওই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেতুটি বাস্তবায়ন হওয়ায় লোকজনকে এখনো উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য শুধু সড়ক পথের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টাও চলছে। নরেন্দ্র মোদি বলেন, ত্রিপুরার সাবরুমে ‘সমন্বিত চেক পোস্ট (আইসিপি)’ পুরোপুরি ‘লজিস্টিক হাব’ হিসেবে কাজ করবে। সেখানে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার জন্য ওয়্যারহাউস, কনটেইনার থাকবে। ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ফলে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সবচেয়ে কাছের উত্তর-পূর্ব ভারতীয় শহর হতে যাচ্ছে আগরতলা। বন্দরের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে দুটি জাতীয় মহাসড়ক (এনএইচ-০৮ ও এনএইচ-২০৮) প্রশস্ত করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
Link copied!