দুর্নীতির লাগাম টানতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এ লক্ষ্যে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক দিয়ে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে। এরপর সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ জমা দেবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত সংস্থা হিসেবে ওয়াসার নিজস্ব লোকবলের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি তেমন সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শুদ্ধি অভিযান চালানোর উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত না করলে কার্যকর ফলাফল মিলবে না।
গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা ওয়াসা অফিস আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, ডিজিটাল ওয়াসা কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সব পর্যায়ের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এ শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ম্যানেজমেন্ট দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল। এ জাতীয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো শুদ্ধি অভিযানের আওতায় কঠোরভাবে দমন করা হবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, কাজে অবহেলা এবং ঢাকা ওয়াসার স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়।
ঢাকা ওয়াসার সচিব জানান, ৭ অক্টোরবর জারিকৃত অফিস আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলমান ও কার্যকর রাখতে সংস্থার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায়কে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এসএম মোস্তফা কামাল মজুদার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিশাত মজুমদার, নির্বাহী প্রকৌশলী জেনি চাকমা, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান, উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বেগম আতিয়া পারভীন, উপ-প্রধান প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রধানীয়া এবং কমিটির সদস্য সচিব নির্বাহী প্রকৌশলী বেগম সাজিয়া পারভীন। এক প্রকৌশলী জানান, ঢাকা ওয়াসার শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোনো অনিয়ম করলে তিনি তাদের প্রতি সদয় থাকেন। এমনকি কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করে ঘটনা যাচাই করে দেখেন না। কিন্তু, শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তার কোনো কাজের বিরুদ্ধে কেউ সমালোচনা করলে, তাদের বিরুদ্ধে খুবই কঠোর হয় চক্রটি। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেই বদলি, বরখাস্তসহ নানাভাবে হয়রানি করছে। এ কারণে ওয়াসার শুদ্ধি অভিযানে এ চক্রের অপছন্দের লোকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকাবাসী বা সুশীল সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসা শুদ্ধি অভিযান কমিটি গঠন করেছে। নিজস্ব লোকবল দিয়ে এ কমিটি করায় তারা কতটুকু স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এ কমিটির মাধ্যমে সুফল পেতে হলে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসাকে যদি তারা সত্যিকারভাবে দুর্নীতিমুক্ত করতে চান, তবে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থেকে সর্বনিু কর্মকর্তা পর্যন্ত সবার সম্পদের হিসাব দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়ে দিক। বিশেষজ্ঞ সদস্য বা ওয়াসার বাইরের সদস্য রাখবেন না কমিটিতে, তাহলে তো কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধেই তো কত অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সে অবস্থায় তাকে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর তার নেতৃত্বে সংস্থার নিজস্ব লোকবল দিয়ে যে শুদ্ধি অভিযান কমিটি গঠন করা হয়েছে, এটি একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এখান থেকে তেমন কোনো সুফল আশা করা যায় না।’ এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আত্মশুদ্ধির উদ্যোগ ভালো। তবে যখন পুরো সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা হয়, তখন ওই সংস্থার নিজস্ব কোনো শুদ্ধি অভিযান কমিটির কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এটা সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের দিয়েই হয়তো গঠন করা হয়েছে। সেহেতু এখান থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না।’ এছাড়া যেসব কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে, তারা নিজেদের স্বজনপ্রীতি বা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পারবেন, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। এজন্য আমার মনে হয়, ঢাকা ওয়াসার শুদ্ধি অভিযানকে কার্যকর করতে হলে নিজস্ব লোকবলের বাইরে বিশেষজ্ঞ সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিদের যুক্ত করার প্রয়োজন। এ কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসার সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কাজে অবহেলা চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবিহত করবেন। আর কমিটির সব প্রকার শুদ্ধি অভিযান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালিত হবে। সততা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গোপনীয়তার সঙ্গে কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কার্যক্রমের ফলাফল লিখিত আকারে শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দাখিল করতে হবে। কমিটির সব জবাবদিহিতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার শুদ্ধি অভিযান কমিটির আহ্বায়ক ও সংস্থার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘একটি ভালো উদ্দেশ্যে ঢাকা ওয়াসা শুদ্ধি অভিযান কমিটি গঠন করেছে। আমরা ইতোমধ্যে প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছি। কমিটির সদস্য সচিব আরও কয়েকটি কমিটিতে থাকায় সময় দিতে পারছে না। এজন্য কমিটি সংশোধন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক বিবেচনায় যারা চাকরি জীবনে সততা ও নিয়মের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন তাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। এদের ব্যাপারে কোনো ভুল-ত্রুটি জানা থাকলে আপনারা তুলে ধরুন, তাহলে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে ওয়াসার সহায়ক হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য বা স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রতিনিধি রাখার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে চিন্তা করা হয়নি। তবে প্রয়োজনে এটা যুক্ত করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনের আলোকে সেটা ভেবে দেখবেন।’