শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

দুদকের করা চাঞ্চল্যকর মামলা: আসামিদের বিরুদ্ধে কঠোর সুপ্রিমকোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:৩৯ এএম, ডিসেম্বর ১০, ২০২০

দুদকের করা চাঞ্চল্যকর মামলা: আসামিদের বিরুদ্ধে কঠোর সুপ্রিমকোর্ট

রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। নানা কৌশলে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) দখল করেন তিনি। শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন। দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকা সরিয়েছেন। এখন তিনি পলাতক। আর আমানতকারীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায়। অবশেষে ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় সম্প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও তাকে গ্রেফতার বা দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এদিকে পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। বুধবার আদালত বলেন, আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দিনটা খুব ভালো দিন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। জানা যায়, দুর্নীতির মামলার আসামিরা বিত্তবৈভব ও প্রভাবশালী। মামলাগুলোর বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব মামলায় অর্ধশতাধিক আসামি কারাগারে রয়েছেন। বিচারিক আদালতে কোনো মামলার বিচার শেষ হয়েছে, কোনোটি চলমান, আবার কানোটি তদন্তাধীন। আসামিরা বিভিন্ন সময়ে উচ্চ ও সর্বোচ্চ আদালত থেকে বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ ও জামিনসহ বিদ্যমান নানা আইনি সুবিধা নিতে আসেন। কিন্তু আদালতের কঠোর অবস্থানের কারণে সফল হতে পারেননি। আসামিরা বেশ কয়েকবার উচ্চ ও সর্বোচ্চ আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ধরনের আসামিদের মধ্যে আছেন, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, সরকারদলীয় এমপি হাজী মো. সেলিম, বিএনপির নেতা মীর নাসির, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ, ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন। জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অনেক দুর্নীতিবাজ এখন কারাগারে। এরা যেন আইনের ফাঁক গলে কারাগার থকে বের হতে না পারে সে জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন সচেষ্ট রয়েছে। চাঞ্চল্যকর মামলা শুধু নয়, দুদকের সব মামলার ক্ষেত্রে আইনি মোকাবেলার জন্য আমরা সর্বদা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত এদের কেউ কোনো আদালত থেকে জামিনে বের হতে পারেনি। আদালত বিচার-বিশ্লেষণ করে আদেশ, নির্দেশনা দিচ্ছেন। আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। দুদকের মামলার আসামিরা উচ্চ আদালতে এসে সফল হতে পারেননি বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার আসামিরা বিভিন্ন সময়ে দুদক সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে জামিনের জন্য এসেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। আদালত বিচার-বিশ্লেষণ করে আদেশ দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু দুদকের মামলা নয়, সকল দুর্নীতির মামলার ক্ষেত্রে আদালত রায় দিচ্ছেন। বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন, সমানভাবে দেখছেন। রায় আদেশ এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। পিকে হালদারের পরোয়ানা ইন্টারপোলে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চান হাইকোর্ট বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদারের গ্রেফতারি পরোয়ানা বিষয়ে প্রতিবেদন, মামলার এফআইআর ও সম্পত্তি-অর্থ জব্দের আদেশ বুধবার আদালতে উপস্থাপন করেন দুদক আইনজীবী। শুনানি শেষে বিচারপতিমো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল বেঞ্চ ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো এবং তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ৩ জানুয়ারি সময়রেখেছেন। এর মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে হবে। এদিকে পিকে হালদারের কাজিন পিপলস লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক অমিতাভ অধিকারী এবং পিকে হালদারের সাবেক সহকর্মী ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীকে এ মামলায় পক্ষভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ এক আদেশে প্রশান্ত কুমার হালদারসহ সংশ্লিষ্ট ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পিকে হালদারকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে ১৯ নভেম্বর তাকে বিদেশথেকেফেরাতে এবং গ্রেফতার করতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হাজী সেলিমের পুরনো মামলার নথি তলব জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর সরকারদলীয় এমপি হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিলবিচারিক আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে হাজী সেলিমের আপিল পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সে নির্দেশনার আলোকেই সম্প্রতি দুদক হাজী সেলিমের আপিল দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন করে। ১১ নভেম্বর হাজী সেলিমের এক যুগ আগের ওই মামলার নথি তলব করেন হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার (আজ) শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে। মীর নাছিরের ১৩ বছরের কারাদণ্ড অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের মামলায় বিশেষ জজ আদালত বিএনপি নেতা মীর নাছিরকে ১৩ বছর ও মীর হেলালকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। বাবা-ছেলের করা পৃথক আপিল শুনানি শেষে বিচারিক আদালতের দেয়া ১৩ বছরের কারাদণ্ড এবং মীর হেলালকে দেয়া ৩ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে গত বছরের ১৯ নভেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। মীর নাছির বর্তমানে কারাগারে আছেন। দুই মামলায় ডেসটিনির রফিকুল আমীনের জামিন নাকচ দুর্নীতি দমন কমিশন ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। গত ২০ আগস্ট বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদন খারিজ করে দেন। সেই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে মামলা দুটির নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেয়া হয়। আবেদন খারিজ, জামিন হয়নি ফারমার্স ব্যাংকের বাবুল চিশতীর : ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল রাজধানীর গুলশান থানায় ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এতে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়। সেদিনই রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে বাবুল চিশতীকে গ্রেফতার করে দুদক। নিম্ন আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর হাইকোর্টে আবেদন করেন তিনি। ওই বছরের ২৬ জুলাই জামিন প্রশ্নে রুল খারিজ করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। হলমার্কের জেসমিনের জামিন বাতিল, আত্মসমর্পণের নির্দেশ : জনতা ব্যাংকের ভুয়া এলসির বিপরীতে ৮৫ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার ৬১৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালে ১৬ জুন হাইকোর্টের দেয়া জামিন বাতিল করে দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ। একইসঙ্গে তাকে চার সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। এনু-রুপনের জামিন আবেদন হাইকোর্টে খারিজ ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হন দুই ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। গত বছর ২৩ অক্টোবর জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দু’জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। এ মামলায় গত ১৫ জুন দুই ভাইয়ের জামিন আবেদন খারিজ করে ঢাকার মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত। এরপর তারা জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট ১৫ সেপ্টেম্বর এক আদেশে কেন তাদের জামিন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২১ অক্টোবর তা খারিজ করা হয়। জি কে শামীমের জামিন বাতিল গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে বিদেশি মদ, অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ নগদ টাকাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন জি কে শামীম। এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে গুলশান থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, অর্থ পাচার ও মাদক আইনে মামলা করে। দুই মামলায় হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পান জি কে শামীম। পরে গত ৮ মার্চ বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি বিশ্বদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তার জামিন আদেশ বাতিল করে আদেশ দেন।
Link copied!