শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

দুঃখিত মামুনুল হক, আপনি ভুল সময় বেছে নিয়েছেন

প্রকাশিত: ০৩:৪১ এএম, এপ্রিল ১১, ২০২১

দুঃখিত মামুনুল হক, আপনি ভুল সময় বেছে নিয়েছেন

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও হলিডে রিসোর্টে যা ঘটেছে তাতে আমরা খুশি নই, ইহা অনভিপ্রেত। আমরা শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক মানুষেরা চাই বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ প্রবহমান থাকবে। সকল বাধা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এমন খবর আমাদের সকলের জন্য সুখকর। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা, দেশ বিরোধী চক্রান্ত, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। পাঠক, যুগ যুগ ধরে আলেম-ওলামাদের প্রতি আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। নিঃসন্দেহে ইহা প্রবহমান থাকবে। ইহাও সত্য যে, ইসলামের বিষয়বস্তু তারা আমাদের চেয়ে বেশি অধ্যয়ন করছেন। এটি একটি সুযোগ যে, আমরা আমাদের আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে শিখি। তাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকার কারণে আমরা তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি। তবে মৌলভী সাহেবরা ফেরেশতা এটা ভাবার অবকাশ নেই। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রিসোর্টে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে ঘেরাও করে রাখা হয়। প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের ভাষ্যমতে, মামুনুল হক একজন নারীসহ রিসোর্টে অবস্থানের খবর পেয়ে স্থানীয় কিছু লোকজন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা ও ফেসবুক লাইভ সাংবাদিকরা তার কক্ষটি ঘেরাও করেন। মামুনুল হক বলছেন, দ্বিতীয় স্ত্রীসহ অবকাশযাপনে গেলে কিছু লোক তাকে নাজেহাল করে। পাঠক, অনভিপ্রেত ঘটনাটি যেদিন ঘটলো সেদিন থেকেই এ নিয়ে নিয়ে সহজ সরল মতামত ব্যক্ত করবো পায়তারা করছিলাম। প্রতিদিন ঘটনা প্রবাহ বিন্যাস্ত হচ্ছে। জ্ঞানী গুণীরা কথা বলছেন, বিশ্লেষণ চলছে। অনেক কিছু শিখছি। পাঠক, ঐদিন শুরু থেকেই লাইভ ব্রডকাস্টিং দেখছিলাম। একটা বিব্রতকর শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি মনে হয়েছিল। বড়ই উদ্বিগ্ন ছিলাম। একটা বড় ধরণের অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। শত শত মানুষ হতাহত হতে পারতো। ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও-এ সাধারণ মানুষের ক্ষতি অবর্ণনীয়। করোনা মহামারির এই ক্ষণে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে মানুষ যে সৃষ্টির সেরা জীব দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা প্রমাণে ব্যর্থ হতে চলছি। বিষয়টি মোটেই সুন্দর দেখায়নি। পাঠক, দেশের জাতীয় নিউজে খবর চোখে পড়েছে -আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বলেছে, নারায়ণগঞ্জের হোটেলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের কর্মকাণ্ড ইসলাম ও আলেম সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। দেখুন, ভুল কেবলই ভুল। যেকেউ ভুল করতে পারে, হতে পারে অজান্তেই। আমাদের দায়িত্ব ন্যায্যতা নিশ্চিত করা, উকিল হিসাবে কাজ না করা। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা উকিল হিসাবে দাঁড়িয়ে যাই, বিভক্ত হয়ে ওঠি। আমাদের মধ্যে কেউ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, কেউবা সত্য ন্যায় পুনরুদ্ধার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি আমাদের ইঙ্গিত করে, আমরা বিভাজনকারী সম্প্রদায় হয়ে ওঠছি। সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পক্ষে এটি ভাল লক্ষণ নয়।
আমার এক ফেবু বন্ধু তার ছোট স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘দয়া করে একটু লজ্জিত হোন, বিব্রত হোন মোহতারাম To Whom This May Concern! নিজেদের দ্বারা সম্পাদিত ভুলের জন্য আমাদের মাথা নত করা উচিত। thank you Zakir Akhtaruzzaman আপনি ঠিকই বলেছেন।’
পাঠক, মাওলানা মামুনুল হকের গাফিলতি মনোভাব সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমি বড়ই বিভ্রান্ত। যে কারণে আমি বলছি, ‘কেন যেন মনে হচ্ছে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভদ্রলোক ব্যর্থ হয়েছেন। মনে হচ্ছে মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে সৃষ্ট ইস্যুতে তিনি অনেকটা অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।’ কেন বলছি? তার ডাকে হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র রাস্তায় বের হয়েছে। অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। আবার অনেক পরিবার স্বজন হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ। দলের নেতাকর্মীরা মামলা হামলার ভয়ে বাড়ি ছাড়া। অনেকেই আছেন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে। আবার তিনি হুংকার ছুঁড়ে বলেছেন- ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের কেউ মারা গেলে জানাজায় অংশগ্রহণ না করার। দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, টান টান উত্তেজনা। বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনাভাইরাসের ভিন্ন রূপ ও সংক্রমণ। দেশের এমন পরিস্থিতিতে ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বে সৃষ্ট সহিংসতার মধ্যে তিনি তাহার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়া বাইরে যাওয়া কোনও বুদ্ধিমান লোকের সিদ্ধান্ত ছিল না বলে আমি মনে করছি। বিষয়টি তিনির কাছে উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত ছিল এই জন্য যে, বাংলাদেশের রাজনীতি ইউরোপের আমেরিকার মত নয় যে কেউ তাকে রাস্তায় উত্তপ্ত বা ধাক্কা দিয়ে উস্কানি দিতে পারে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের কেউ মারা গেলে জানাজায় অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ- এটা যেকোনও রাজনৈতিক দলের সদস্যের জন্য অপমানজনক। আমাদের জিহ্বা এক ভয়াবহ অস্ত্র। তিনি নিজের অজান্তে ব্যর্থ হয়েছেন বিষয়টি নোট করতে। আমি দুঃখিত মাওলানা মামুনুল হক আপনি সিকিউরিটি নিশ্চিত না করে স্বল্প বিরতির জন্য ভুল সময় বেছে নিয়েছেন। পাঠক, দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি প্রতিটি নাগরিকের শ্রদ্ধা থাকা উচিত। মামুনুল হককে একজন প্রশ্ন করেছেন ‘কবে বিয়ে করছেন’? ‘বিয়ে করলে রয়্যাল রিসোর্টে কেন সময় কাটাতে আসবেন’? প্রথমত এটা একটা স্টুপিড প্রশ্ন। আমি সামান্য সংশোধন করতে চাই। দেশের সকল রিসোর্টে যেসব নারী-পুরুষ রাত্রিযাপন করেন তারা বিবাহিত না অবিবাহিত তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সাধারণ নাগরিকের নয়। স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গেলে কাবিননামা সঙ্গে রাখতে হবে বাংলাদেশে এরকম কোন আইন নেই। কাবিননামা দেখতে চাওয়ার অধিকার শুধুমাত্র পারিবারিক আদালতের রয়েছে। বিয়ে বৈধ কিনা সেটা ঘোষণা করার একমাত্র ক্ষমতাও পারিবারিক আদালতের। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিয়ে নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলার অধিকার রাখে না। কে কার স্ত্রী, কে কার স্বামী না- সেটা দেখবে আইন। আমরা সচেতন নাগরিক কোন অনৈতিক কাজকে সমর্থন করতে পারি না। এই পরিস্থিতিতে আমরা পুলিশকে ইনফর্ম হতে পারি। এর চেয়ে বেশি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। পাঠক, প্রশ্ন তুলতেই পারেন তাহলে কেন মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন এমন আচরণ করলো? খুব সহজ। সংঘাতে সংঘাত বাড়ে। আপনি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, সরকার আপনার ওপর নজর রাখবে। দুর্ভাগ্যক্রমে মামুনুল হক তা নোট করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় হেফাজতে ইসলাম দেশে যে তাণ্ডব ঘটিয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। সরকার তাদের কওমি মাদ্রাসার সনদ দিয়েছে। পাঠ্যক্রম ঠিক করে দিয়েছে। তারা যেন দেশ-বিদেশে চাকরি পায় তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারপর কেন এই তাণ্ডব? মামুনুল হকের আচরণ রাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনির নেতৃত্বে বৈধ কারণ ছাড়া সরকার হটাও আন্দোলন। সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, দেশের একটি জেলার সকল স্থাপনা ভেঙে চুরমার করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুংকার, অতঃপর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে মুখ থেঁতলে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আসতে দেয়া যাবে না। পাঠক, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বিদেশি মেহমানদের বাড়িতে রেখে বাড়ির সদস্য বা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আপনাদের দ্বারা সৃষ্ট সহিংসতা দেশ, জাতি, রাষ্ট্র নীরবে অবলোকন করেছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন সরকার ভয় পেয়েছে, ওরা সরকারকে ‘Take over’ করে ফেলেছে? মোটেও ঠিক না। মেহমান বাড়িতে রেখে রাষ্ট্র আপনাদের সঙ্গে হানাহানিতে সম্পৃক্ত হতে পারেন না। সরকারের নীরবতাকে দুর্বলতা ভেবে যারা ঘোড়া তরবারি নিয়ে বাংলাদেশকে আফগান রাষ্ট্র পরিণত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন তা কঠোর হস্তে দমন করা যেকোনো সরকারের কাজ। বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে আপনি সরকার হটাও আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ আপনার নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। আমাদের ধর্মান্ধ না হয়ে ধর্মভীরু হওয়া উচিৎ। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি দ্বারা সবকিছু বিশ্লেষণ করা উচিৎ। দেশের জাতীয় নিউজের খবর রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে আটকের পর নিজের ভুল স্বীকার করেছেন ‘শিশুবক্তা’ খ্যাত মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী। ‘আর ভুল হবে না’ এমন নিশ্চয়তা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে অনুরোধও জানান। রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, কী আর বলবো স্যার, ওয়াজের মঞ্চে যখন উঠি তখন শরীরে একটা জোস চলে আসে। এ জোসের কারণে অনেক সময় হুঁশ থাকে না। তখন আর নিজেকে ধরে রাখা যায় না। অনেক কিছু না বুঝেই বলে ফেলেছি। আর এমন হবে না। এবারের মতো আমাকে মাফ করে দেন। তাই বলতে চাই ধর্মকে যারা সঠিক কাজে ব্যবহার করছেন না পুলিশ পাকড়াও করার পর সকলই একি আচরণ করবেন। আলোচনা শেষ করতে হবে, একটি অনুরোধ রেখেই শেষ করতে চাই। দেশে অনেক জ্ঞানী-গুণী হক্কানি আলেম ওলামা আছেন যারা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। কোরআন সুন্নার আলোকে নবী করিম সা: এর জীবন বিধান আদর্শ সম্বলিত সভা সেমিনার ও মসজিদভিত্তিক বয়ানের মাধ্যমে তারা যদি আমাদের মধ্যে আল কোরআনের আলো ছড়িয়ে দেন- তাহলে আমরা উপকৃত হব। আমাদের ঈমান আমল আকিদা আখলাক আরো মজবুত হবে। জ্ঞানী গুণী হক্কানি আলেম-ওলামা নিয়ে জাতীয়ভাবে নীতিমালা তৈরি করে একটি কমিটি করে উক্ত কমিটির নেতাদের দিয়ে যদি মাস দুই এক সামাজিক মাধ্যম, ইউটিউবের ওয়াজ নসিয়তগুলো পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করেন তাতেই তারা উপলব্ধি করতে পারবেন ইসলাম নিয়ে আমরা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা কী সমস্যার মধ্যে আছি। গান, বাজনা, হাসি, ঠাট্টা, মস্করা দিয়েই মুসল্লিদের মাতিয়ে রাখা হচ্ছে- যা থেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পরিশেষে বলতে চাই, সমাজে শিষ্টাচার নেই। ইহা অশুভ লক্ষণ। আমরা মারমুখী হয়ে ওঠছি। রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া কোন দেশপ্রেমিক সুনাগরিকের কাজ না। দেশবিরোধী অন্যায়-অনিয়ম কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত দেশের বড় বড় রাঘব বোয়ালদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আগামীতেও হোক, আর সেটা যাতে হয় দেশের প্রচলিত আইনে। লেখক: ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দ্য ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম। *** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
Link copied!