শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারে দায় কার?

প্রকাশিত: ০৩:১৫ এএম, আগস্ট ১৪, ২০২০

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারে দায় কার?

অ্যাপ ও অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরুর পর যাত্রীরা ভেবেছিল—যাক, এবার বোধ হয় টিকিট পাওয়ার ভোগান্তি-বিড়ম্বনা কমবে, কালোবাজারি বন্ধ হবে। এখন হচ্ছে উল্টোটা। আগে রেলস্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে, কখনো বা ধাক্কা-গুঁতা খেয়ে, ন্যায্য মূল্যে টিকিট পেত বহু যাত্রী। এখন প্রতিদিন অ্যাপ-অনলাইনে বিক্রি শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানানো হয়, টিকিট শেষ। অথচ কালোবাজারে টিকিটের অভাব নেই। এসব টিকিট প্রকৃত মূল্যের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এই কালোবাজারিচক্র বছরের পর বছর টিকিট হাতিয়ে নিয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছে। অনেক সময় সার্ভারে থাকা টিকিট ব্লক করে রেখে বাড়তি দামে বিক্রি করে। অথচ অভিযোগ পেয়েও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেলওয়ে। অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে কেনা টিকিট কারো কাছে বিক্রি করলে বিক্রেতাকে জেল, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেবে রেল। আর অন্যের কাছ থেকে টিকিট কিনলে যাত্রীকেও বাড়তি জরিমানা করবে। যাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে টিকিট মিলিয়ে দেখা হবে। ট্রেন টিকিট এক্সামিনারের (টিটিই) হাতে থাকা অনলাইন বোর্ডে যাত্রীর নাম, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখা হবে। তথ্য না মিললে সার্ভারে থাকা নম্বর মিলিয়ে যার নামে টিকিট কেনা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কালোবাজারি ঠেকাতে নেওয়া এই উদ্যোগে বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি ও কালোবাজারি বন্ধ হবে এবং যাত্রীরা নিজে টিকিট কাটতে উদ্বুদ্ধ হবে বলে মনে করছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, এটা সবে শুরু করছি। কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিলে সেটা সমাধান করা হবে।’ রেলওয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ট্রেন ভ্রমণে কেনা টিকিট, রিটার্ন টিকিট ও নির্দিষ্ট মেয়াদি টিকিট হস্তান্তরযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি বা যাত্রী টিকিট কিনবে শুধু সে-ই ট্রেন ভ্রমণ করতে পারবে। নিজে টিকিট কিনে অন্য কোনো যাত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হলে বিক্রেতা তিন মাস কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উয়ভ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর ক্রেতা ওই টিকিট নিয়ে ভ্রমণ করলে একক ভ্রমণের সমান অতিরিক্ত ভাড়ায় দণ্ডিত হবে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে নিজে টিকিট কেটে রেল ভ্রমণ ও অন্যের নামে কেনা টিকিটে রেল ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে রেলওয়ে। এই সিদ্ধান্তে কলোবাজারি ঠেকিয়ে ট্রেনের টিকিটে স্বচ্ছতা বাড়ার আশা করা হলেও ইন্টারনেট বা প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত নয়, এমন যাত্রীরা সমস্যায় পড়বে। আবার যাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই বা ইন্টারনেট চালাতে পারে না তারা সমস্যা পড়বে। ঈদে কিংবা যেকোনো উৎসবে ঘরে ফেরা মানুষের চাপ বাড়লে ট্রেনের টিকিট নিয়ে কালোবাজারি বাড়ে। কখনো দ্বিগুণ, আবার কখনো তিন গুণ দামেও টিকিট কেনাবেচা হয়। করোনা মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে ট্রেন চলছে। বাসে ভাড়ার পরিমাণ ৬০ শতাংশ বাড়ানো হলেও ট্রেনের ভাড়া অপরিবর্তিত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেনে ভ্রমণে মানুষের আগ্রহ বাড়লেও টিকিট নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষের কমতি নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক টিকিট বিক্রি করায় টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঈদুল আজহায় ঘরে ফেরা ও ঈদ শেষে রাজধানীতে ফেরা মানুষকে তিন, চার বা পাঁচ গুণ দামে টিকিট কিনতে হয়েছে। এই পরিস্থিতি এখনো চলছে। ময়মনসিংহ থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়ামুল কবীর সজল জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথে বর্তমানে দুটি ট্রেন অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা এক্সপ্রেস চলাচল করছে। তিস্তা শোভন চেয়ারের টিকিটের দাম ১৪০ টাকা আর ব্রহ্মপুত্র শোভন চেয়ারের দাম ১২০ টাকা। অথচ তিন-চার গুণ বেশি দামে ৭০০-৮০০ টাকা করে কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে টিকিট। জেলার গফরগাঁও রেলস্টেশনে টিকিট কালোবাজারিচক্রের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বেড়েছে। ঢাকা-জামালপুরের মধ্যেও এই দুটি ট্রেন চলাচল করছে। জামালপুর প্রতিনিধি জানান, সেখানে ২২৫ কিংবা ২৫০ টাকার টিকিট কালোবাজারে এক হাজার, এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম জানান, রাজশাহী-ঢাকা রেলপথে বনলতা এক্সপ্রেসের সাধারণ সিটের ভাড়া ৩৭৫ টাকা, অথচ কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে এক হাজার টাকায়। কেবিনের ভাড়া ৮৬৫ টাকা, কালোবাজারে টিকিট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে সিল্কসিটি, ধূমকেতু ও পদ্মা ট্রেনের টিকিটও কালোবাজারে তিন-চার গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব জানান, চট্টগ্রামেও বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারে চলে যাচ্ছে, যা কিনতে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনসংলগ্ন নগরের রিয়াজুদ্দিন বাজার, তামাকুমণ্ডি লেন, নিউ মার্কেটসহ আশপাশের বিভিন্ন দোকানে কালোবাজারিরা এসব টিকিটের বিপরীতে বাড়তি টাকা আদায় করছে। মেঘনা এক্সপ্রেসের এক যাত্রী জানান, তাঁর কাছ থেকে ১৬৫ টাকার টিকিট ৫০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। সাধারণত যাত্রার পাঁচ দিন আগে থেকে অ্যাপ ও অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটা যায়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন সকাল ৬টায় অনলাইনে টিকিট ছাড়ার এক বা দুই মিনিটের মধ্যে সব টিকিট শেষ হয়ে যায়! কেউ কেউ সিট বরাদ্দ পেয়ে টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখে টিকিট বিক্রি শেষ! কালোবাজারিচক্র অনলাইনে সক্রিয় হয়ে একযোগে টিকিট কেটে নেয় বলে অভিযোগ যাত্রীদের। কালোবাজারি রোধে যে টিকিট কিনবে, তাকেই ট্রেন ভ্রমণ করতে হবে; অন্যের কাছ থেকে টিকিট কিনলে জরিমানা গুনতে হবে যাত্রীকে—রেলের এই উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, কালোবাজারিচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বাধ্য হয়ে টিকিট কেনা যাত্রীদের বিরুদ্ধে রেলওয়ের ব্যবস্থা নেওয়াটা হবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো ব্যাপার। সূত্র জানায়, করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে ট্রেনের শতভাগ টিকিট এখন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। যাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বরে দিয়ে রেলসেবা অ্যাপস ও বংযবনধ.পহংনফ.পড়স ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে টিকিট কিনতে পারছে যাত্রীরা। আগে অর্ধেক টিকিট অনলাইন আর অর্ধেক কাউন্টারে বিক্রি করা হলেও করোনা পরিস্থিতিতে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যেসব যাত্রী প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নয়, তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ছে। রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, করোনায় সীমিত পরিসরে সারা দেশে মাত্র ১৭ জোড়া ট্রেন চলছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চলায় অন্যান্য পরিবহন চলমান থাকা এবং যাত্রীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১৬ আগস্ট রবিবার আরো ১২ জোড়া নতুন ট্রেন চালু হবে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনের টিকিট নিয়ে মানুষের অসন্তোষ দূর হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
Link copied!