মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

ছিঁচকে চোর থেকে ‘মামা বাহিনী’র প্রধান দেলোয়ার

প্রকাশিত: ০৩:৫০ এএম, অক্টোবর ৯, ২০২০

ছিঁচকে চোর থেকে ‘মামা বাহিনী’র প্রধান দেলোয়ার

হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজিসহ পাঁচ মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেল্যা চোরা পুলিশের খাতায় দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ছ্যাঁচড়া চোর থেকে দেলোয়ার কিশোর গ্যাং ‘মামা বাহিনী’ গড়ে তোলে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার এখলাসপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নে তার বাহিনীর ক্যাডার সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ জন। বাহিনীর ক্যাডাররা চুরি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই, নারী নির্যাতন ও ইভটিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত। অনেকের প্রয়োজনে থানার গোলঘরে সালিশদার হিসেবেও গেছে দেলোয়ার। বেগমগঞ্জ থানার দু-একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও সহকারী সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। অথচ পুলিশ বলছে তাকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে, এলাকাবাসী বলছেন, দেলোয়ার গ্রামেই ছিল। এলাকাবাসী জানান, দেলোয়ারের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। চুরি-চামারি-ছিনতাই, অস্ত্রবাজি করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সে অর্থ আদায় করত। একে মেরে, ওকে হুমকি দিয়ে ও চাঁদাবাজি করে তার দিন কাটত। অস্ত্র বিক্রি ও অস্ত্র ভাড়া দিয়ে সে অর্থ কামাই করত। এলাকাবাসী জানান, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আলমগীর কবিরের পক্ষে একটি ভোট কেন্দ্র দখল করে দেলোয়ার আওয়ামী লীগ নেতাদের নজরে আসে। যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিপুল ভোটে হেরে যান। এরপর দেলোয়ার এলাকার যুবলীগ নেতায় পরিচিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মামুনুর রশিদ কিরণের পক্ষে নির্বাচন করে। নির্বাচনের পর বিশাল মোটরসাইকেল মিছিল করে কিরণকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে দেলোয়ার আওয়ামী লীগের নেতা বনে যায়। এমপি কিরণকে ফুলের তোড়া দেয়া ছবি দিয়ে দেলোয়ার পোস্টার, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার তৈরি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, এমনকি উপজেলা ও জেলা সদরেও টাঙিয়ে দেয়। কিন্তু এখলাসপুরে ২ সেপ্টেম্বর নারীকে বিবস্ত্র করে মারধরের ছবি ভাইরাল হলে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে নোয়াখালীসহ গোটা দেশ ফুঁসে উঠে। দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার প্রধান সহযোগী বাদলকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। নারায়ণগঞ্জ থেকে দেলোয়ার, কেরানীগঞ্জ থেকে বাদল এবং অন্য আসামিদের মধ্যে আবদুর রহিম, রহমত উল্যা, সাজু, সোহাগ মেম্বার, সোহাগ ও রাসেলকে বেগমগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অস্ত্র মামলায় দেলোয়ার এবং বেগমগঞ্জ থানায় শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে বাদলসহ নয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। দেলোয়ার হোসেন : বেগমগঞ্জ উপজেলার ছায়েদুল হকের তিন ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় দেলোয়ার। দেলোয়ারের বড়ভাই আনোয়ার হোসেন ও ছোটভাই মিন্টু ইয়াবা ব্যবসা, গরু চুরি, সিঁদেল চুরি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। রোববার র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে দেলোয়ার। বেগমগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ চাঁদাবাজি, রাহাজানি, বিস্ফোরক আইনে চারটি মামলা রয়েছে। নতুন করে তার বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অস্ত্র আইনে একটি, বেগমগঞ্জ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (ধর্ষণ) একটি মামলা হয়েছে। বেগমগঞ্জ এলাকার একটি মসজিদের পেশ ইমাম (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, দেলোয়ার ছোটবেলায় বাড়ি-বাড়ি চুরি করত। পুকুরের মাছ চুরি করত। ৭-৮ বছর আগে সিএনজি চালাতে শুরু করলেও দেলোয়ারের সঙ্গে বেগমগঞ্জের হাজীপুরের সুমন বাহিনী ও জিরতলীর ফাজিলপুরের নিজাম বাহিনীর সখ্য হয়। এরপর সিএনজি চালানো ছেড়ে দিয়ে দেলোয়ার কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান এনে বিক্রি শুরু করে। এর সঙ্গে সে অস্ত্র বেচাকেনা ও অস্ত্র ভাড়া দেয়াও শুরু করে। এ ব্যাপারে এখলাসপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন জানান, দেলোয়ার বা তার বাহিনীর কেউ আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তবে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার প্রশ্রয়ে তারা অস্ত্রবাজি করে। এদিকে, সংবাদ সম্মেলন করে বেগমগঞ্জ আসনের এমপি মামুনুর রসিদ কিরণ জানিয়েছেন, দেলোয়ারকে তিনি চেনেন না। নির্বাচনে জয়লাভের পর কোন ফাঁকে তাকে ফুল দিয়েছিল তা তার জানা নেই। দেলোয়ার, সুমন ও নিজাম বাহিনীসহ সব ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতারের দাবি জানান এমপি কিরণ। দেলোয়ার বাহিনীর অন্য ক্যাডাররা হল- বাদল (২০) : দেলোয়ারের কিশোর গ্যাং ‘মামা ক্যাডার বাহিনী’ নির্ভরযোগ্য সদস্য হল বাদল। এলাকার কেউ তার বাবার পরিচয় দিতে রাজি হননি। যদিও মামলার এজাহারে তার বাবার নাম রহমত উল্যা উল্লেখ করা হয়ছে। মধ্যম এখলাসপুর মহরম আলী মুন্সী বাড়িতে বসবাসকারী বাদল ছোটবেলা থেকে ঘাত-প্রতিঘাতে বড় হয়েছে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখলের পর সে ছাত্রলীগ নেতা বনে যায়। ছাত্রলীগ নেতার নাম ভাঙিয়ে এলাকায় সে চাঁদাবাজি করে। দেলোয়ারের নির্দেশে কক্সবাজার থেকে সে ইয়াবা ও অস্ত্রের চালান আনে। তার নেতৃত্বে রয়েছে মিনি ক্যাডার কিশোর গ্যাং বাহিনী। গাবুয়া থেকে রেল লাইন এবং টেলিভিশন সেন্টার ও শরীফপুর এলাকায় প্রবাসীরা বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে তাকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে রাতে তারা বাড়িঘর ভাংচুর করত। ২০১৯ সালে তিনবার ডিবি পুলিশ তাকে মাদকসহ গ্রেফতার করে। কিন্তু দলীয় নেতাদের সুপারিশে সে ছাড়া পায়। এরপর থেকে সে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বেই নারীকে নির্যাতন ও বিবস্ত্র ছবি তোলা হয়। ওই ছবিতে তাকে বারবার দেখা গেছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে বেগমগঞ্জ থানায় সোপর্দ করেছে। বর্তমানে সে ৬ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। আবদুর রহিম (২০) : বাদলের প্রধান সহযোগী ও দুর্ধর্ষ ক্যাডার আবদুর রহিম। তার বাবার নাম শেখ আহমদ ওরফে দুলাল। দেলোয়ারের কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে রহিম সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। ৫-৬ সজন ক্যাডার নিয়ে রহিম সারা রাত রাস্তায় চলাফেরা করে। গভীর রাতে চলাচলকারী সিএনজি, অটোটেম্পো থামিয়ে যাত্রী ও চালকদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া তার পেশা। তবে রহিমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। সাজু (২২) : গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেলোয়ারের ক্যাডার গ্রুপে নাম লেখায় পূর্ব এখলাসপুরের লোকমান মিয়ার ছেলে সাজু (২১)। ইয়াবা ব্যবসা, ভাড়াটিয়া ক্যাডার হিসেবে মানুষের সম্পত্তি দখল, চাঁদাবাজি, সড়কে গাড়ি আটকে টাকা আদায় করে সাজু। কক্সবাজার থেকে অস্ত্র ও ইয়াবা আনে সাজু। ২-৩ বার ডিবি পুলিশের হাতে আটক হলেও দলীয় নেতারা তাকে ছাড়িয়ে আনেন। সুধারাম থানায় তার বিরুদ্ধে দুটি মাদক মামলা আছে। সে জামিনে রয়েছে। রহমত উল্যা (৩০) : মধ্যম এখলাসপুরের আবদুল করিমের ছেলে রহমত উল্যা এক সময় দিনমজুর ছিল। ইউপি নির্বাচনে দেলোয়ারের ক্যাডার বাহিনীতে সে যোগ দেয়। এরপর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে ভাড়া খাটা শুরু করে। মাদক বিক্রির টাকা আদায় করত রহমত। সে নিজেকে জেলা শ্রমিক লীগের নেতা হিসেবেও পরিচয় দিত। দু’বার ডিবির হাতে মাদকসহ আটক হওয়ার পরও দলীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সে ছাড়া পায়। নুর হোসেন (৩০) : এক সময় ছোটখাটো ব্যবসা করলেও দেলোয়ারের ক্যাডার বাহিনীতে ভিড়ে নুর হোসেন মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এলাকায় সে যুবলীগ নেতা হিসেবেও পরিচয় দিত। জায়গা জমি ক্রয়-বিক্রয় করলে তাকে চাঁদা দিতে হতো। তাকে ৩ থেকে ৫ শতাংশ টাকা না দিলে কেউ জমির দখল পেত না। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর গাবুয়ায় আমেরিকান প্রবাসীর বাড়িতে তার নেতৃত্বে হামলা হয়। এ সময় দুই লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে নুর হোসেন। মানিক (২১) : দেলোয়ারের কিশোর গ্যাং ‘মামা বাহিনীর’ সদস্য মানিক লেখাপড়া জানে না। মাদক ব্যবসা তার পেশা। মাদক সেবন করে মানিক কয়েকবার তার বাবা-মাকে মারধর করেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার বাবা বলেন, এ ছেলেকে সরকার ফাঁসি দিলে তিনি তার লাশও গ্রহণ করবেন না। মানিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা আছে। তার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে বা মুখ খুলতে সাহস পান না। আবুল কালাম (২৩): দেলোয়ারের ডানহাত আবুল কালাম জয়কৃষ্ণপুর খাল পাড়ের জুলফিকার আলী বাবুলের ছেলে। দেলোয়ারকে চাহিদামতো এলাকার কেউ চাঁদা না দিলে তার ওপর হামলা করে চাঁদা আদায় করা ছিল কালাম ওরফে কালার কাজ। দেলোয়ারের অস্ত্র ভাণ্ডার দেখাশোনা করে কালাম। এছাড়া অস্ত্র ভাড়া নিয়ে ফেরত না দিলে বা টাকা দিতে দেরি করলে তাদের ধরে এনে শাস্তি দেয়াও ছিল তার কাজ। তার বিরুদ্ধে থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। মাদকসহ তাকে পুলিশ দু’বার ও ডিবি পুলিশ তিনবার আটক করে। তবে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সে ছাড়া পেয়ে যায়।
Link copied!