শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঘুষ দিলেই হালাল সব অবৈধ কাজ

প্রকাশিত: ০৬:০২ এএম, মে ২০, ২০২১

ঘুষ দিলেই হালাল সব অবৈধ কাজ

রাজধানীর অনেক অভিজাত আবাসিক এলাকা অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকার বাসা-বাড়িতে অসামাজিক কার্যকলাপ, মাদক ব্যবসাসহ অপরাধজগতের প্রায় সব ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু প্রশাসন ও হাউজিং সমিতির নেতারা নির্বিকার। প্রশাসন ম্যানেজ মাসোহারায়। আর কাঙ্ক্ষিত ঘুস দিলেই হাউজিং সমিতির নেতাদের কাছে সবই জায়েজ। অনুসন্ধানে এমন সব তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। কল্যাণ সমিতিগুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি এবং পালটাপালটি দখল প্রসঙ্গে স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় প্রতিবেশীসুলভ পরিবেশ, নিরাপত্তা ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় কল্যাণ সমিতিগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সমালোচনার বদলে এগুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় সবকিছুই যেন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। সব ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ী মনোভাব কাজ করে। ফলে কল্যাণ সমিতির ধারণা এখানে ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা এবং শক্ত মনিটরিং ব্যবস্থা চালু থাকলে ভালো হয়। সূত্র বলছে, রাজধানীর বনশ্রী, মিরপুর, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, ওয়ারী ও যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। এছাড়া নিকেতন, গুলশান এবং ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে অবৈধ জুয়া, মিনি ক্যাসিনো, মাদক ও ম্যাসাজ পার্লারসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে নির্বিঘ্নে। এতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। সবাই কমবেশি প্রভাবশালী। এছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কল্যাণ সমিতির অসাধু নেতাদের প্রচ্ছন্ন ছায়া রয়েছে। ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড রাতারাতি হালাল হয়ে যায়। অনেক এলাকায় সমিতির নেতারা নিজেরাই নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। সূত্র বলছে, রাজউকের নিয়মানুযায়ী আবাসিক এলাকায় স্কুল, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলার কথা নয়। এমনকি উচ্চ শব্দের যন্ত্র ব্যবহারও নিষিদ্ধ। অথচ বিউটি পার্লার থেকে শুরু করে গার্মেন্ট, অফিস-আদালত এবং ভারী শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে অনেক এলাকায়। মাইক বাজিয়ে হকারদের পণ্য বেচাকেনা হচ্ছে অহরহ। শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। রাজধানীর নিকেতন এলাকায় বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলে আসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে দুটি হোটেল নিকেতনের আবাসিক পরিবেশ নষ্ট করছে। বি ব্লকের ২ নম্বর রোডের এক বাড়িতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একটি হোটেল চলছে। এখানে অসামাজিক কার্যকলাপের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। এছাড়া ই ব্লকের ৮ নম্বর রোডের অপর বাড়িতে গড়ে ওঠা হোটেলে একাধিকবার অভিযান চালায় ডিবি। এতে প্রচুর বিদেশি মদ, ইয়াবাসহ অসামাজিক কাজে লিপ্ত তরুণ-তরুণীদের আটক করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে হোটেল দুটি বন্ধের উদ্যোগ নেই। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন বলেন, নিকেতনের আবাসিক হোটেলগুলোয় অসামাজিক কার্যকলাপের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো নিয়ে নিকেতন সোসাইটির নেতাদের সঙ্গে অনেকবার কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। উপরন্তু সমিতির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকায় সিমেন্ট, বালু, রডসহ নির্মাণসামগ্রী বোঝাই ট্রাক ঢুকলেই চাঁদা দিতে হয়। চাঁদার রেট কোথাও ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়া এলাকাভেদে নির্মাণকাজ শুরুর আগে ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়। অনেক জায়গায় সমিতির নেতাদের কাছ থেকে নির্মাণসামগ্রী নেওয়া বাধ্যতামূলক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসিক এলাকায় সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা নিজ গ্রামের এলাকা থেকে লোক এনে সিকিউরিটি গার্ড পদে নিয়োগ দেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করতে এটা করা হয়। কেউ কেউ আবার সিকিউরিটি গার্ডদের মাধ্যমে ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজিও করেন। এমনকি সিকিউরিটি গার্ডদের দিয়ে বিশেষ বিশেষ ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিকদের ওপর নজরদারি করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গাড়ি, বাড়িসহ সম্পদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের পর তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। টার্গেটকৃত ব্যক্তি অসাধু সরকারি কর্মকর্তা হলে তো কথাই নেই। দুদকের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে সমিতির নামে বড় অঙ্কের ডোনেশন আদায় করা হয়। সম্প্রতি একটি হাউজিং সমিতিতে এ রকম ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে কল্যাণ সমিতির এক নেতা ২৮ এপ্রিল বিস্ময়কর তথ্য দেন। তিনি উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতিতে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিমাসে সমিতির নামে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। এ টাকার হিসাব কেউ কখনো দেয় না। অথচ নিবন্ধিত কল্যাণ সমিতির হিসাব প্রতিবছর অডিট করানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমিতির পক্ষ থেকে নামসর্বস্ব কোনো একটি সিএ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেট) ফার্ম দিয়ে হিসাব অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। আবার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে অনেক সময় বাড়িওয়ালা বা ফ্ল্যাট মালিককে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়ে দেওয়ারও নজির আছে। দেখা যায়, কারও বাড়ি থেকে গৃহকর্মী পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার সুযোগ কাজে লাগায় সমিতির নেতারা। পুলিশকে উসকে দিয়ে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস আদায় করা হয়। বেইলি স্কোয়ার অফিসার্স কোয়ার্টার ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি চলছে। এখানে মোট ১৬টি ভবনে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাস। আবাসন পরিদপ্তরের আওতাধীন ভবনগুলোয় ৩০০ সরকারি কর্মকর্তা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। আবাসিক পরিবেশের উন্নয়নের কথা বলে এখানেও একটি কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়। বর্তমানে এ সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রকট দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করে আসছে। সর্বশেষ সমাজসেবা কার্যালয়েও লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। বুধবার সরেজমিন এ এলাকায় দেখা যায়, ভবনগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো এবং জরাজীর্ণ। আশপাশে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ঢাকনাবিহীন ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কয়েকটি ভবনের সামনে বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী ভেঙে পড়ে আছে। বেশির ভাগ খেলার রাইড ব্যবহারের অনুপযোগী। ১০ নম্বর ভবনের পেছনে অনেকটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের আদলে বড় একটি মুদি দোকান খোলা হয়েছে। দোকানের কর্মচারী নির্মল জানান, এ দোকানের মালিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব আবুল কালাম আজাদ। দোকান থেকে মাসিক ভাড়া আদায় করে কল্যাণ সমিতি। আবাসিক এলাকার দুটি প্রধান ফটকে দুইজন করে নিরাপত্তারক্ষীকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে কথা হয় দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষী আবুল বাসারের সঙ্গে। এলাকার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে সিটি করপোরেশন থেকে ময়লা নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া ঢাকনা দিয়ে রাখলে লাভ হয় না। কারণ পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঢাকনা খুলে একবার ময়লা নেওয়ার পর আর ঢাকনা লাগায় না। তিনি বলেন, কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে এখানে ১৬ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের বেতনভাতা সবই সমিতি থেকে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপসচিব বলেন, কল্যাণ সমিতির নামে প্রতিমাসে ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া কনভেনশন সেন্টার এবং খোলা মাঠ ইজারা দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হলেও তহবিলের স্বচ্ছতা নেই। তিনি বলেন, গত বছর অফিসার্স ক্লাবে আয়োজিত আয়কর মেলার সময় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৬ লাখ টাকা তোলা হয়। বেইলি স্কোয়ার অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান বুধবার দোকান বসানোর কথা যুগান্তরের কাছে স্বীকার করে বলেন, আশপাশে কোনো বাজার না থাকায় দোকানটি বসানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখান থেকে কিছু ভাড়াও নেয় কল্যাণ সমিতি। তিনি বলেন, দোকান খোলার জন্য কোথাও অনুমোদন নিতে হয় কি না, তা তার জানা নেই। সূত্র: যুগান্তর
Link copied!