শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঘুষ খেকো ডিজির বদলি

প্রকাশিত: ০৫:৫১ এএম, জানুয়ারি ১০, ২০২১

ঘুষ খেকো ডিজির বদলি

ডেইলি খবর ডেস্ক: ঘুষ দিলেই বদলি, না দিলে হয়রানি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজি শেখ রফিকুল ইসলামের হাতে এই ভাবে পুরো দপ্তরটাই জিম্মি হয়েছিলো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকেও খুব একটা ভয় তিনি করতেন না। এইভাবেই চলছিলো সমাজসেবা অধিদপ্তরে। অবশেষে তাকে বদলী করায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ডিজির ঘুষগ্রহণের নানারকম ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত রির্পোটে জানা গেছে টেকনাফের একজন শহর সমাজসেবা অফিসার সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গায় বদলি হয়েছেন এক লাখ টাকা উৎকোচের মাধ্যমে। পঞ্চগড় থেকে আরেকজন হাসপাতাল সমাজসেবা অফিসার পদে ঢাকায় এসেছেন প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে।এভাবে সারাদেশের ৪৬০টি উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজনীয় বদলি/পদায়নে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হচ্ছে ঢাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরে। বিভাগীয় পরিচালক ও জেলা উপপরিচালকদের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলি/পদায়নের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শেখ রফিকুল ইসলাম একহাতে কুক্ষিগত করায় সংশ্লিষ্টরা এভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অভিযোগ মতে, ডিজির একঘুয়ে নীতির কারণে সমাজসেবা কার্যালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়মিত কাজ বাদ দিয়ে বদলির জন্য ঢাকায় দৌঁড়াতে একদিকে যেমম চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তররের কাজ হচ্ছে ব্যহত । এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক তদ্বির ও অর্থ বাণিজ্যেরও অভিযোগ এখন ওপেন-সিক্রেট। ডিজির দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একটি ঘুষ লেনদেনের চক্র। বিভাগীয় পরিচালক ও জেলা উপপরিচালকদের হাতে বদলি/পদায়নের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা আমলে নিচ্ছেন না ডিজি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বদলি জটিলতায় সমন্বয়ের অভাবে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে বহু পদ শুন্য থাকাসহ সমাজসেবা অধিদপ্তরে চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের একটি সার্কুলার অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালকরা বিভাগের মধ্যে আর উপপরিচালকরা জেলার মধ্যে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা প্রয়োগ করে আসছিলেন। কিন্তু সমাজসেবা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি শেখ রফিকুল ইসলাম নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই সেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এককভাবে নিজের হাতে নেন। এতে পঞ্চগড়, বরগুনাসহ বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত একজন সমাজসেবা কর্মীকে বদলি বা পদায়নের জন্য ঢাকায় আসতে হয়। এতে তাদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মীরা মন্ত্রণালয়ের নজরে আনলে গত বছরের ২১ অক্টোবর সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে আগের নির্দেশনাটি মানার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-৪) মোহাম্মদ জিয়াউল হক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নোটিশে বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়কে তার কর্ম অধিক্ষেত্রে কর্মরত উপজেলা কর্মকর্তা/সমমান কর্মকর্তাদের বদলি/পদায়ন এবং নন-গেজেটেড কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশাসনিক কর্মসম্পাদনের (পদায়ন,বদলি,ছুটি,আপিল ও শৃংখলা সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিকরণে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি) দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরে ২০২০ সালের ৪ মার্চ সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক অফিস আদেশে মন্ত্রণালয়ের ওই নোটিশের ২ নম্বর অনুচ্ছেদের বাক্যে বিভাগীয় পরিচালকগণকে নিয়োগ/বদলির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয় না উল্লেখ করে তাদেরকে কোন প্রকার বদলি না করার অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে মহাপরিচালক বরাবর প্রস্তাব প্রেরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ফলে পরিচালক, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের ওপর মন্ত্রণালয়ের দেয়া দায়িত্ব খর্ব করা হয়েছে। তাছাড়া উপপরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয় কর্তৃক নিজ কর্মক্ষেত্রের মধ্যে বদলি/পদায়ন স্থগিত রাখায় দীর্ঘসূত্রিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় অফিস আদেশটি প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া উপপরিচালকদের তাদের কর্ম অধিক্ষেত্রের মধ্যে বদলি/পদায়নের প্রচলিত ব্যবস্থা জনস্বার্থে অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদানের জন্যও অনুরোধ করা হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা তামিল না করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজি গত বছরের ২৮ অক্টোবর উল্টো মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দুই পৃষ্টার একটি চিঠি দিয়ে তার অবস্থানের পক্ষে ব্যাখ্যা দেন। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে ডিজির সেই ব্যাখ্যা আমলে না নিয়ে আগের আদেশ পালনের জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেটাও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখনও ডিজি তার নিজের মত করে বদলি/পদায়নের কাজ করছেন। সূত্রমতে, দেশের ইউনিয়নগুলোতে ২ হাজার ৮০০ সমাজকর্মীর পদ আছে। কিন্তু ৮০০ পদ শুন্য রয়েছে। জনবল কম থাকায় দ্রæত বদলির মাধ্যমে শুন্যপদগুলোতে সমন্বয় করতেন উপপরিচালক ও পরিচালকরা। কিন্তু বর্তমানে তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়ায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাজে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর সমাজসেবা অধিদফতরে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই সময় দুদক জানায়, ২০১৮ সালের ১১ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে অধিদফতরের ৪৩৮ জন ইউনিয়ন সমাজকর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের এক শিক্ষককে। অথচ ফার্মেসি অনুষদের ডিন বিষয়টি জানতেন না। আর এ-সংক্রান্ত নিয়োগের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ফার্মেসি অনুষদের ওই শিক্ষকের ছিল না। পরে ওই পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হলেও আজও জড়িতদের চিহ্নিত বা শাস্তিমুলক ব্যবস্থা করা হয়নি। বন্ধ রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়াও। এদিকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার ও ইউনিয়ন সমাজকর্মীদের বদলি/পদায়ন ঢাকায় ডিজির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এক্ষেত্রে তদ্বির ও অর্থবাণিজ্য বেড়েই চলেছে। প্রতিটি উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে বর্তমানে সমাজসেবা অফিসার, শহর সমাজসেবা অফিসার,হাসপাতাল সমাজসেবা অফিসার, প্রবেশন অফিসার, রেজিস্ট্রেশন অফিসার, সরকারি এতিমখানা উপ তত্তাবধায়ক, ফিল্ড সুপারভাইজার, ইউনিয়ন সমাজকর্মী, কারিগরি প্রশিক্ষক, অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক সহ প্রায় ১৫টি পদে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, অর্থ ও তদ্বিরের মাধ্যমে ক্ষমতাধররা যেমন তাদের পছন্দের দপ্তরে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে দুর্নীতি অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তেমনি তৃণমূল পর্যায়ের অসহায় কর্মীরা তাদের প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট একটি মহল সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজির সহযোগী হিসেবে বদলি/পদায়নে অর্থ বাণিজ্য করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র- কালের কন্ঠ
Link copied!