শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

করোনা সুরক্ষাসামগ্রীর স্তূপ বন্দরে

প্রকাশিত: ০৪:২৭ এএম, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০

করোনা সুরক্ষাসামগ্রীর স্তূপ বন্দরে

সরকারের তথ্য ও ভাষ্য অনুসারে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। নিশ্চিত আক্রান্ত রোগী শনাক্তের হার কমছে, হাসপাতালেও রোগী কমছে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা কমে আসার পাশাপাশি চাহিদা কমছে সুরক্ষাসামগ্রীরও। যদি আর সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী না হয় তাহলে এসবের চাহিদা না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন বন্দরে পড়ে থাকা কোটি কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ করোনাভাইরাসকেন্দ্রিক সুরক্ষা ও চিকিৎসা সামগ্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে এসব সামগ্রী গত জুন-জুলাই মাসের মধ্যে সরকারকে বুঝিয়ে না দেওয়ায়, বন্দরে পড়ে থাকায় ভাড়া পরিশোধ নিয়েও তৈরি হচ্ছে জটিলতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার মধ্যেই এখন আরেক সমস্যা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বন্দরে পড়ে থাকা সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে। কভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত যেসব হাসপাতালে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র জরুরিভাবে সংগ্রহ করার কথা হয়েছিল, সেগুলো সময়মতো সরবরাহ করা হয়নি। ওই হাসপাতালগুলো এখন বন্ধ করে দেওয়ায় ওই সব সরঞ্জাম কোথায় কিভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটা ঠিক করা যাচ্ছে না। যেখানে ওই যন্ত্রগুলো দেওয়া হবে সেখানে উপযোগিতা কতটা থাকবে-না থাকবে কিংবা সেগুলো ঠিকভাবে ব্যবহার হবে কি না, প্রয়োজনীয় জনবল ওই হাসপাতালে থাকবে কি না, সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। অবশ্য এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, এসব সামগ্রী অন্যান্য হাসপাতালে বিতরণের জন্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার মাধ্যমে একটি পরিকল্পনার কাজ চলছে। যাতে ওই সামগ্রী অপচয় বা অব্যহৃত না থাকে সেদিকে নজর রেখেই যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, গত মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জরুরি প্রয়োজন মেটাতে কার্যাদেশ দেওয়া বিভিন্ন সুরক্ষা ও চিকিৎসাসামগ্রী জুন ও জুলাই মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে পাওয়ার কথা ছিল। তবে কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওই প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এমনকি জুলাইয়ের মধ্যে অনেক পণ্যই দেশের বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছলেও তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দুই লাখ মাস্ক, ৫০ হাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), এক লাখ হ্যান্ড গ্লাভস, দুই লাখের বেশি করোনা টেস্ট কিট, এক লাখ ৬০ হাজার স্টিক ও ভিটিএম, প্রায় দুই হাজার পালস্ অক্সিমিটার, ৪০০-এর বেশি অক্সিজেন কনসেট্রেটর ও ৩০০ ভেন্টিলেটর বন্দরে থাকার কথা; যা নিয়ে চিন্তায় আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন প্রশাসন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানিয়েছে, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে বন্দরে আটকে থাকা স্বাস্থ্য খাতের পণ্যগুলো দ্রুত ছাড় করাতে এনবিআর কাজ করছে। তবে পণ্যের মান নিয়ে কোনো আপস নেই। তাই সংশ্লিষ্ট সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মতিপত্র এনবিআরে পৌঁছানোর পরই আমদানীকৃত পণ্য বন্দর থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। এনবিআর সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এনবিআর করোনা প্রতিরোধে বা করোনা চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য আমদানীকৃত পণ্য দ্রুত ছাড় করাতে প্রস্তুত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতিপত্র লাগবে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, অনুমতিপত্র পেতে যদি বিলম্ব হয় তবে এনবিআর তার জন্য দায়ী নয়। তিনি আরো বলেন, ‘টিভিতে দেখেছি, পেপারে পড়েছি, কিছু অসাধু ব্যক্তি করোনা চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য বা করোনা প্রতিরোধে নিম্নমানের পণ্য আমদানি করেন। এতে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ছে। সরকারি এসব পণ্য বন্দরে পড়ে থাকলেও প্রতিদিনই বিশেষ প্রক্রিয়ায় যাঁরা বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন, তারা লাগেজে করে বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা পণ্য নিয়ে আসছেন। এনবিআরের কাছেও এমন অভিযোগ রয়েছে।’ এনবিআর সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, এনবিআর সীমিত লোকবল নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কিন্তু এটা ঠিক প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল অনেক কম। তাই বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রতিটি লাগেজ যাচাই করে দেখা সম্ভব হয় না। আর এ সুযোগে কোনো কোনো যাত্রীর ব্যাগে করে নিম্নমানের করোনা সুরক্ষাসামগ্রী যেমন—পিপিই বা মাস্ক দেশে ঢুকে যেতে পারে। তবে আগের চেয়ে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। বন্দরে পড়ে থাকা সামগ্রীর মধ্যে জাদিদ অটোমোবাইলসের আমদানীকৃত বেশ কিছু পণ্যও রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র। প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে—এমন অভিযোগ পাওয়ার পর এর মালিক শামীমুজ্জামান কাঞ্চনকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে দুদকে হাজির হতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এসংক্রান্ত নথিপত্রও তলব করা হয়েছে। কভিড-১৯ সংক্রান্ত জরুরি প্রস্তুতিমূলক প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাওয়া স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতির তথ্য, কোন কোন হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ সরবরাহ করা হয়েছে, কী পরিমাণ মজুদ আছে, তার আইটেমভিত্তিক তথ্য চেয়েছে দুদক। এ ছাড়া ওই প্রকল্পের আওতায় ওই একই তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কী পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে—এসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও দুদক চেয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী আমদানির অনুমতির জন্য ‘জাদিদ অটোমোবাইলস’ থেকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে দাখিলকৃত আবেদনপত্র ও ওই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া অনুমতিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপিও চেয়েছে দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথি অনুসারে দেখা যায়, জাদিদ অটোমোবাইল কম্পানিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপারেডনেস প্রকল্পের’ আওতায় এক ধাপে ৫০ হাজার এন৯৫ মাস্ক, এক লাখ ৫০ হাজার কেএন৯৫ মাস্ক, ৫০ হাজার পিপিই, এক লাখ হ্যান্ড গ্লাভসের কার্যাদেশ দেওয়া হয় এবং তা দেশে আসে। সূত্র: কালের কণ্ঠ
Link copied!