শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

করোনা পরীক্ষার নামেও প্রতারণা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭ এএম, জুলাই ৭, ২০২০

করোনা পরীক্ষার নামেও প্রতারণা

একটি বেসরকারি ব্যাংকে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কাজ করেন তানিয়া পলি। থাকেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে। তাঁর স্বামীও একজন ব্যাংকার। করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়ও দায়িত্ব পালন করেছেন দুজনই। গত মে মাসের শুরুতে তাঁর স্বামী, ভাই ও মায়ের জ্বরসহ করোনার লক্ষণ দেখা দিলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তানিয়া। করোনা পরীক্ষার জন্য ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের সহযোগিতা চান। ফেসবুকে ওই পোস্ট দেখে মাহমুদ হুসাইন নামের এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। করোনা পরীক্ষার সব ব্যবস্থা ও বাসায় গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি। তানিয়া বলেন, “তিনি (মাহমুদ) যোগাযোগের পর থেকে বিভিন্ন আশ্বাস দিলেও পরীক্ষা করতে না পেরে আমরা বাইরে গিয়ে নমুনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু অসুস্থ রোগী ও ছোট্ট শিশুকে বাইরে না নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বাসায় নমুনা দিতে পারলে ভালো হতো বলে মনে হচ্ছিল। তাই ৭ মে পুনরায় ফোন দিয়ে তাঁকে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাই এবং বাসায় নমুনা সংগ্রহ করলে ‘প্রয়োজনে খরচ’ করার ইচ্ছা পোষণ করি।” ৮ মে সকাল ১১টায় খিলগাঁওয়ের ওই বাসায় নুমনা সংগ্রহ করতে আসেন বিপ্রজিত তালুকদার নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একজন কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। তানিয়া বলেন, ‘আমাদের পাঁচজনের নমুনা সংগ্রহ করে তিনি চলে যান। করোনা সন্দেহে নমুনা সংগ্রহের আগে ফরমে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয় তার কিছুই করা হয়নি। পরে ফরমের কথা বললে ৮ মে বিকেলে ফোন দিয়ে ফরমের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি।’ নমুনা সংগ্রহের পরের দিন ৯ মে রাত ১০টা থেকে ২০ মের মধ্যে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঁচজনের করোনার ফলাফল পাঠানো হয়। তানিয়া বলেন, ‘আমার মা ও ভাইয়ের জ্বর ও শ্বাসকষ্টে সেসময় তাঁদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তাঁদের করোনা হয়েছে, কিন্তু রিপোর্টে সবাইকে নেগেটিভ দেখানো হলো। তাই পরের দিন (১০ মে) খিলগাঁও গার্লস কলেজ বুথে গিয়ে পুনরায় করোনার নমুনা দিই। সেই রিপোর্টে আমার মা পজিটিভ হন। আর স্যাম্পল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমার ভাই ও স্বামীকে পুনরায় স্যাম্পল দিতে বলা হয়। পুনরায় স্যাম্পল দিলে আমার ভাইয়ের ও পরে আমার স্বামীরও করোনা পজিটিভ আসে।’ বিষয়টি আইইডিসিআরের পরিচয়ধারী বিপ্রজিতকে জানালে এরপর তিনি আর কোনো টাকা দাবি করেননি বা নিতেও আসেননি। গত ১৫ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের বাসিন্দা এক মুক্তিযোদ্ধাসহ একই পরিবারের তিনজনের করোনার নমুনা সংগ্রহ করতে যান বিপ্রজিত। নমুনা সংগ্রহের সময় কোনো ধরনের পিপিই ছাড়াই সাধারণ পোশাকে ও পায়ে হেঁটে গিয়ে ওই বাসায় নমুনা সংগ্রহ করেন তিনি। জনপ্রতি তিন হাজার টাকা করে মোট ৯ হাজার টাকা নেন। এর তিন দিন পর ১৮ মে ই-মেইলে তিনজনের ফলাফল পাঠানো হয়, যাতে তিনজনেরই করোনা নেগেটিভ দেখানো হয়। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ফলাফল নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় ওই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পুনরায় করোনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। ২২ মে স্কয়ার হাসপাতালে পরীক্ষা করালে ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর স্ত্রীর করোনা পজিটিভ আসে। করোনা রিপোর্টে প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলে মুক্তিযোদ্ধার ওই পরিবারকে বিকাশের মাধ্যমে খরচসহ ৯ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষমা চান বিপ্রজিত। ওই দুটি ঘটনা ছাড়াও করোনার নমুনা সংগ্রহের নাম করে একাধিক জায়গার লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার তথ্য রয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করতে এসে দেওয়া নম্বর বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাই করে বিপ্রজিতের পরিচয় নিশ্চিত হন এই প্রতিবেদক। বিপ্রজিত বর্তমানে রাজধানীর বিজয় সরণিতে সিএসবিএফ নামের আরেকটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন। রোগী সেজে আইইডিসিআরের কর্মচারী পরিচয় দেওয়া বিপ্রজিত তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। ‘দুই-আড়াই হাজার টাকা বেশি দেওয়ার কথা বলা হলে প্রথমে বাসায় এসে করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য রাজি হলেও পরে বাসায় আসতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এরপর কয়েক দিন তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর কালের কণ্ঠ’র পরিচয়ের কথা বলা হলে গত বুধবার বিপ্রজিত বলেন, ‘আমি (নুমনা সংগ্রহের জন্য) কোথাও গেছি বলে মনে পড়ছে না।’ আইইডিসিআরে কাজ করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইইডিসিআরে কাজ করে প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরতে লেট হওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’ করোনা পরীক্ষার জন্য অর্থ আদায় করায় আইইডিসিআর থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধই পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের জনবল সংকট কাটাতে আমরা কিছুসংখ্যক অস্থায়ী মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছিলাম দৈনিক ভিত্তিতে। তাঁদের মধ্যে ওই বিপ্রজিতসহ দুজনের বিরুদ্ধে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে তাঁদের চাকরি থেকে বাদ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ওই ব্যক্তি যাদের কাছ থেকে ১৫-১৬ হাজার টাকা (মোট) এনেছিল তা উদ্ধার করে বিকাশের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’ সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি অভিযানে পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘এই হাসপাতালটি গত এক মাস ধরে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমন অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ গত ১৫ জুন রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করতে আসাদের মধ্যে কয়েকজনকে প্রতারণার মাধ্যমে এই সরকারি হাসপাতালের প্যাডে ভুয়া করোনার রিপোর্ট প্রদান করার অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩। পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বিনিময়ে পাশের কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে এসব রিপোর্ট তৈরি করে দেওয়াই ছিল ওই চক্রের কাজ। এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও সিল নকল করে করোনা পরীক্ষার ভুয়া প্রত্যয়নপত্র বিক্রির অভিযোগে সাভারে দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
Link copied!