দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সদ্য সাবেক হওয়া আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি এই পাবলিক প্রতিষ্ঠানটিতে এমডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন মাত্র এক বছর চার মাস। এই সময়ে নিজের এবং স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার মাধ্যমে কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগ, বদলির কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য লিখিতভাবে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলেও সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে ১৬৩ জনকে নিয়োগ এবং দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করেছেন। এ বাবদ তাঁর পকেটে গেছে ১২ কোটি টাকা। আর ঝড়ের গতিতে চাকরিবিধি উপেক্ষা করে নিজের জন্যও একাধিক পদোন্নতি বাগানোর তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিডিবিএফের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা কার্যালয়ের সিনিয়র উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা (সিনিয়র পিডিবিএফ) ছিলেন শেখ মো. আবুল বাশার। ২০১৭ সালে সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের নামে তিন লাখ ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি করে প্রতিষ্ঠানটি। তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় বিভাগীয় মামলা হয়। ওই মামলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাঁকে সিনিয়র থেকে জুনিয়র পদে এবং বেতন স্কেলের নিম্ন ধাপে অবনমিত করা হয়। পাশাপাশি আত্মসাৎ করা টাকা এক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানকে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। শাস্তি-পরবর্তী সময়ে বগুড়ার পাঁচবিবি উপজেলায় তাঁকে বদলি করা হয়। কিন্তু আমিনুল ইসলাম ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের এমডি হয়েই মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সাজাপ্রাপ্ত বাশারকে পদোন্নতি দিয়ে জামালপুর জেলায় ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালকের দায়িত্ব দেন।
আরেক ঘটনায় বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা পিডিবিএফের উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা হয়। ২০১৫ সালে ৪৪ হাজার ৯৬ টাকা আত্মসাৎসহ গ্রামের মানুষকে সোলার প্যানেল বরাদ্দ দেখিয়ে নিজের পরিবারের ব্যবহারের অভিযোগে ওই মামলা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকেও শাস্তিস্বরূপ বেতন স্কেলের এক ধাপ নিচের পদে অবনমিত করা হয়। কিন্তু এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকেও আমিনুল আর্থিক সুবিধা নিয়ে উচ্চতর পদ ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (ডিডি) হিসেবে লালমনিরহাট জেলায় দায়িত্ব দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু আবুল বাশার আর আব্দুর রহমানই নন, গ্রামের দরিদ্র মানুষের ঋণের টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ থাকা টাঙ্গাইলের আব্দুল্লাহ আল মামুন, পাবনার গোলাম মোস্তফা, ময়মনসিংহের আবু ইউসুফ মো. শাজাহানসহ ৩৪ জনকে ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক পড়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু আমিনুল সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং দায়িত্ব না দিয়ে এ রকম দুর্নীতিবাজ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি এবং সুবিধাজনক জায়গায় বদলির মাধ্যমে পকেটে পুরেছেন ঘুষের কয়েক কোটি টাকা।
আমিনুল ইসলামের দুর্নীতি এবং অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। সাজাপ্রাপ্তদের পদোন্নতিই শুধু নয়, মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আমিনুল ছয়টি পদে নতুন করে ১৬৩ জন নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নেন ১০ কোটি টাকার বেশি। নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়ন করা, স্বজনদের অ্যাকাউন্টে ঘুষের টাকা লেনদেন, ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ, হাজামাজা প্রকল্পের পুকুর খনন ও মাছ চাষ প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাতের তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে তদন্তে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. খালিদ পারভেজ খানের নেতৃত্বে উপসচিব কেরামত আলী ও সিনিয়র সহকারী সচিব আরিফুল হককে নিয়ে ওই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
অভিযোগ আছে, আমিনুল নিজেও তাঁর প্রমোশন বাগিয়ে নেন দুর্নীতির মাধ্যমে। পিডিবিএফের সব পদে পদোন্নতির জন্য চাকরির প্রবিধানমালা অনুযায়ী তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার বিধান থাকলেও এ বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয় তাঁর ক্ষেত্রে। সাবেক এমডি মাহাবুবুর রহমানকে ম্যানেজ করে মাত্র এক বছর ছয় মাসের মধ্যে ২০১৩ সালে উপপরিচালক থেকে যুগ্ম পরিচালক পদে পদোন্নতি নেন তিনি। এরপর নিয়মমাফিক অতিরিক্ত পরিচালক পদে উন্নীত হন। অতিরিক্ত পরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি পেতে প্রবিধানমালা অনুযায়ী পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তিন বছর ১৪ দিনের মাথায় প্রভাব খাটিয়ে তিনি হয়ে যান পরিচালক। এরপর সিনিয়র দুজন পরিচালককে ডিঙিয়ে এবং হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটিও নিজের করে নেন আমিনুল। তাঁকে এই পদে বসানোর নেপথ্য কারিগর হিসেবে ছিলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েই দুর্নীতির মচ্ছব শুরু করেন আমিনুল। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত সুত্রে জানা গেছে, তিনি আবার আগের পরিচালক পদে ফিরেছেন গত বছরের ২১ ডিসেম্বর।
আমিনুল এই পাবলিক প্রতিষ্ঠানের একজন স্থায়ী কর্মচারী হয়েও নিজের মালিকানাধীন কম্পানি সানার্জি টেকনোলজিস লিমিটেডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে কোটি কোটি টাকার সোলার সামগ্রী সরবরাহ করেছেন। একইভাবে তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন কম্পানি ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অ্যাঙ্গিরা ইলেকট্রনিকসও সোলার সামগ্রীসহ বিভিন্ন ফার্নিচার সরবরাহ করে। জয়েন্ট স্টক কম্পানির প্রফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, সানার্জি টেকনোলজিসে এক নম্বর শেয়ার হোল্ডার হিসেবে আছেন আমিনুল। এই কম্পানির পাঁচ হাজার শেয়ার রয়েছে তাঁর মালিকানায়। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের কম্পানির মাধ্যমে সৌর শক্তি প্রকল্পেরও সভাপতি ছিলেন আমিনুল। সৌর শক্তি প্রকল্পের পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ কাজে লাগিয়ে নিজের এবং স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে ব্যবসা করেছেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী।
সানার্জি ও অ্যাঙ্গিরার প্রফাইল ও কার্যাদেশপত্র যাচাই করে দেখা যায়, আমিনুলের মালিকানাধীন সানার্জি টেকনোলজিসকে এক কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আর স্ত্রীর মালিকানাধীন অ্যাঙ্গিরা ইলেকট্রনিকসকে চার কোটি টাকার কার্যাদেশ দেন। স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানকে সোলার সামগ্রী কেনার জন্য আরো প্রায় পাঁচ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে। একইভাবে মুজিবশতবর্ষ পালন উপলক্ষে ‘চেতনায় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রচারের কথা বলে কৌশলে ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আমিনুলের বিরুদ্ধে। এমডি থাকাকালে বিভিন্ন মামলায় আইনি খরচের নামে ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়, যা অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। নিয়োগ, পদোন্নতি আর নিজের ও স্ত্রীর নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আমিনুলের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তার পরে ফাউন্ডেশনে নিয়োগ পাওয়া নতুন এমডি মুহম্মদ মউদুদ উর রশীদ সফদার বলেন, ‘উনার বেশ কিছু অনিয়মের বিষয়ে আমি জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় তদন্তও করছে। আরো কয়েকজন পরিচালকের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ মউদুদ উর রশীদ বলেন, পিডিবিএফের বোর্ড উনার বিষয়টি জানেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চেষ্টা করছি যতটা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করা এবং প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে ৩০০ কোটি টাকা প্রণোদনাও দিয়েছে সরকার। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পিডিবিএফ পরিবার কৃতজ্ঞ।’