শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আরো দুই ‘মালেক’

প্রকাশিত: ০৩:৫৪ এএম, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০

আরো দুই ‘মালেক’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেকের দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের ঘটনা ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নানা ধরনের দুষ্কর্মের কাহিনি। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এমন বেশ কয়েকজন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নেতার কাহিনি বেরিয়ে এসেছে, যাঁরা সবচেয়ে নিচের পদে কাজ করেও দাপট আর বিত্তে হার মানিয়ে দেন অনেক উঁচু পদের কর্মকর্তাকেও। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. আবু সাঈদ মিয়া। আরেকজন হলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় পানি উন্নয়ন শ্রমিক-কর্মচারী লীগের (৮৮) সভাপতি মোহাম্মদ মাহবুব আলম। মো. আবু সাঈদ মিয়া : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, আবু সাঈদ মিয়া টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে জাতীয় পার্টির সরকারের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অফিস সহায়ক পদে চাকরি হয় তাঁর। এরপর ধীরে ধীরে হাসপাতালের তত্কালীন কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পাশাপাশি সহকর্মীদের মধ্যে নিজের অবস্থান শক্ত করতে থাকেন। সংগঠনের ওপরের পদে ওঠার জন্য তিনি ওই সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও একসময়ের দাপুটে কর্মচারী নেতা আব্দুল খালেকের ডান হাত হিসেবে কাজ করেন। আবু সাঈদ চতুর্থ শ্রেণির অফিস সহায়ক পদে ছিলেন। এখন তিনি চলতি দায়িত্বে তৃতীয় শ্রেণির কিচেন সুপারভাইজর পদে কর্মরত। কর্মচারীরা জানান, সমিতির সভাপতি আব্দুল খালেক অবসরে গেলে এবং কর্মচারী সমিতির নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেই সভাপতি পদে আসীন হন মো. আবু সাঈদ মিয়া। এরপর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি, বরং আগের তুলনায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেন হাসপাতালের বিভিন্ন কাজের। বিশেষ করে হাসপাতালের কিচেন সুপারভাইজরের দায়িত্ব কৌশলে দখল করে নেন আগের সুপারভাইজর হেলালউদ্দিনকে সরিয়ে, যার মধ্য দিয়ে রোগীদের তিন বেলার খাবার থেকে পরিমাণে ও মানে কম দিয়ে নিজের ভাগ্য ফেরাতে শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, বেনামে তিনিই ওই খাদ্য সরবরাহ করে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, প্রতিদিন একসঙ্গে বাজার এনে সেখান থেকে এক অংশ হাসপাতালের রান্নাঘরে যায় এবং বাকিটা যায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আরএস হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁয়। জানা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে আরএস হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ নামের ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি স্ত্রীর নামে চালাচ্ছেন আবু সাঈদ। হোটেলটির আগের নাম ছিল ‘সিয়াম হোটেল’, যার মালিক ছিলেন পেয়ার আলী নামের এক ব্যবসায়ী। প্রভাব খাটিয়ে তাঁর কাছ থেকে হোটেলটি দখল করে নেন সাঈদ। হোটেলের পেছনের অংশ অবৈধভাবে হাসপাতালের জমিতে বাড়িয়েছেন। এই হোটেল ব্যবসা ছাড়াও বসিলা এলাকায় একাধিক আবাসন কম্পানির অংশীদার সাঈদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মালেকের মতোই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে কর্মচারী নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন আবু সাঈদ মিয়া। অভিযোগ আছে, আরো কয়েকজনের সঙ্গে মিলে তিনি ২০১০ সালে হাসপাতালের বিভিন্ন পদে প্রায় ৫০ জন কর্মচারীকে নিয়োগ পাইয়ে দেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দু-তিন লাখ টাকা করে নেন। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে নিজের স্বজনদের বিভিন্ন পদে চাকরি পাইয়ে দেন আবু সাঈদ। তাঁর এক ভাই রফিক আছেন অফিস সহায়ক পদে, আরেক ভাই আশ্রাফ আছেন সরদার হিসেবে, আরেক ভাই মনির ছিলেন অফিস সহায়ক পদে, এখন তিনি কাজ করেন ব্লাডব্যাংকে টেকনোলজিস্ট হিসেবে। এ ছাড়া সম্প্রতি তাঁর ছেলে ও মেয়ের জামাইকেও চাকরি দেওয়া হয়েছে মাস্টাররোলে। কর্মচারী সমিতির সভাপতি হওয়ার সুবাদে হাসপাতালে আবু সাঈদের দাপট আরো বেড়ে গেছে বলেও জানা যায়। করোনা সংক্রমণের পর হাসপাতালে মাস্টাররোলে নিয়োগ হয়। সাঈদ প্রায় ১৫ জন শ্রমিককে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন। এবারও জনপ্রতি দু-তিন লাখ টাকা করে নিয়ে এই কাজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে; যদিও যাঁরা কাজ পেয়েছেন, তাঁরা কেউ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিপন মিয়াও চার-পাঁচজনকে চাকরি দেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি কোয়ার্টারে একটি বাসা বরাদ্দ পেলেও সেটি ভাড়া দিয়েছন আবু সাঈদ মিয়া। নিজে থাকেন কাছেই একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটে। আগে আবু সাঈদ মিয়াকে একটি গাড়ি ব্যবহার করতে দেখেছে অনেকেই। কিছুদিন ধরে সেই গাড়ি তিনি হাসপাতালের কাছে আনেন না। ছেলেরা চালান দামি মোটরসাইকেল। নিজের চালচলনেও বড় কর্মকর্তার মতো ভাবভঙ্গি থাকে সব সময়। সঙ্গে থাকে একাধিক সহযোগী। অন্যদিকে আবু সাঈদ মিয়ার দাপটে তাঁর অন্য ভাই, ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনও হাসপাতালজুড়ে রীতিমতো রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকেন অন্য সাধারণ কর্মচারীরা। এমনকি হাসপাতালে অনেক কর্মকর্তা সাঈদ ও তাঁর লোকজনকে সমীহ করে চলেন। হাসপাতালে নানা ধরনের কেনাকাটা, ঠিকাদারি কাজেও এই আবু সাঈদ চক্রের হাত থাকে বলে জানান একাধিক কর্মকর্তা। জানা যায়, ২০১৭ সালে আবু সাঈদ মিয়াকে দুই দফা কিডনি হাসপাতালে বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু তিনি সেই বদলি ঠেকিয়ে দিয়ে এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কর্মচারী সমিতির সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি কোনো দুর্নীতির মধ্যে নেই। আমার কী আছে না আছে, তা সবাই জানে, সব পরিষ্কার। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমার নামে কী আছে না আছে, তা-ও সবাই জানে। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থা আমার আইডি কার্ড চেক করে দেখেছে।’ বসিলায় আবাসন ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে আমরা ৩০ জন মিলে একটি প্লট নিয়েছি।’ মোহাম্মদ মাহবুব আলম : জাতীয় পানি উন্নয়ন শ্রমিক-কর্মচারী লীগের (৮৮) সভাপতি মোহাম্মদ মাহবুব আলম চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে প্রবেশ করেন; যদিও সংগঠনটির নিবন্ধন নেই। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তাঁর বাবা। কর্মচারীদের নেতা হওয়ার সুবাদে তিনি এখন একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন মতিঝিলের ওয়াপদা (পাউবো) ভবনসহ আশপাশে এই দপ্তরের যতগুলো শাখা আছে সব কটির কর্মচারীদের মধ্যে। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর কথার বাইরে কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে না কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ-বদলিসহ নানা ধরনের কাজের মাধ্যমে মাহবুব আলম নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন দিনে দিনে। এরই মধ্যে রাজধানীতে চার থেকে পাঁচটি বহুতল ভবনের মালিক হয়েছেন তিনি। রাজধানীর মানিকনগরে বিদ্যুত্ টাওয়ারের পাশে রয়েছে তাঁর সাততলা একটি ভবন। মিরহাজিরবাগে রয়েছে চারতলা আরেকটি ভবন। হাসনাবাদ এলাকায়ও একটি ভবনের মালিক তিনি। এ ছাড়া নামে-বেনামে পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে করেছেন বিভিন্ন সম্পত্তি। চলেন দামি গাড়িতে। রয়েছে বেনামে অনেক ব্যবসা। সংগঠনের সাবেক সভাপতি বহুল আলোচিত আবুল কালাম মোল্লার মৃত্যুর পর কপাল খুলে যায় মাহবুব আলমের। বর্তমানে পাউবোর তৃতীয় শ্রেণির ডুপ্লিকেটিং অপারেটর পদে কর্মরত প্রভাবশালী মাহবুব আলম তদবির বাণিজ্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি-বাড়ি নয়, মাহবুব আলম তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে রীতিমতো পাউবো দপ্তর ও যাত্রাবাড়ী কলোনির ভেতরে বেপরোয়া প্রভাব বিস্তার করে আছেন। তিনি ছাড়াও একই দপ্তরে বর্তমানে তাঁর আরো এক ভাই ও দুই ভাতিজাসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয় চাকরি করছেন। বিভিন্ন সূত্র জানায়, মাহবুব আলমের বাবা চাকরি করতেন পাউবোতে। সেই সূত্রে তাঁর দুই ভাইয়ের চাকরি হয়। তাঁদের সুবাদে তিনিও চাকরি পান এই দপ্তরে। যাত্রাবাড়ী ওয়াপদা কলোনি নামে পরিচিত পাউবোর কলোনিতে তাঁর নিজের নামে একটি সরকারি বাসা বরাদ্দ থাকলেও সেখানে তিনি থাকেন না। সেটি ভাড়া দিয়েছেন। নিজে থাকেন বাইরে অন্য জায়গায়। একইভাবে তাঁর এক ভাইয়ের নামে একটি বাসা বরাদ্দ আছে। তাঁর দুই ভাতিজার নামেও আছে। তুষার নামের মাহবুব আলমের এক ভাতিজা পাউবোর নৌযানের সেইলর পদে কর্মরত; যদিও তিনি সব সময় থাকেন প্রধান কার্যালয়ে। কলোনির ১ নম্বর ভবনের পূর্ব পাশের বাসায় থাকেন তিনি। কলোনিতে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছেন গবাদি পশুর খামার। সরকারি পুকুরে জোর করে মাছ চাষ করে পুকুরটি নিজের দখলে রেখেছেন। সেই মাছ প্রকাশ্যেই বিক্রি করেন। নিজের সুবিধামতো বিক্রি করেন সরকারি গাছগাছালি। তাঁর নানা অপকর্ম নিয়ে একটি তদন্ত হলেও সেটি অদৃশ্য কারণে একপর্যায়ে চাপা পড়ে যায়। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবুব আলম বলেন, ‘আমি সংগঠনের সভাপতি পদে আছি সাত মাস ধরে। আমার বিরুদ্ধে অনেকেই নানা অভিযোগ তোলে তাদের নিজেদের স্বার্থে। অনেক ধরনের তদন্ত হয়েছে আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি কোনো দুর্নীতি করি না। যদি আমরা দুর্নীতি করতাম, তাহলে এত ছোট পদে চাকরি করা লাগত না।’ বাড়ি-গাড়ির মালিক কিভাবে হয়েছেন জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘আমি চাকরি পাওয়ার আগে কিছুদিন কুয়েতে ছিলাম। তখন কিছু টাকা-পয়সা ছিল। এ ছাড়া আমার শ্বশুর অনেক ধনী। সাততলা একটি ভবন করেছি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে। চারতলা ভবনটি করে দিয়েছে আমার সম্বন্ধী।’ আত্মীয়-স্বজন এবং অন্যদের চাকরি দেওয়ার বিষয়ে মাহবুব আলম বলেন, ‘কাউকে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তারা নিজেরাই চাকরি পেয়েছে। তবে সম্প্রতি দৈনিক ভিত্তিতে আমার এক ভাইয়ের ছেলেসহ কয়েকজনকে কাজ দিয়েছি একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে। এই ছেলেগুলোকে এই চাকরি না দিলে ওরা হয়তো সামাজিকভাবে বিপদগ্রস্ত হতো। মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি তাদের উপকার করেছি।’
Link copied!