দেশের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’কেও এক ধরনের উপায় মনে করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। গত আগস্ট মাস থেকে ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তবে এর আগের সাত মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারায় ১৮৪ জন। আর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে এ ধরনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৭। অর্থাৎ চার মাসে প্রাণহানির সংখ্যা তিন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পেশাদার সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও জঙ্গিরা মাঠে তৎপরতা চালায়। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। আর এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিতর্কিত ‘ক্রসফায়ার’-এর দিকে ঝোঁক তৈরি হয়।
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, ‘সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের (৩১ জুলাই) পর অর্থাৎ অতিসম্প্রতি দেশে বন্দুকযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে এ সময়ের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা তেমন ঘটেনি।’ তবে দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে অপরাধপ্রবণতাও অনেক কমেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে ৬২ জন। এর মধ্যে ৩৭ জনের নিহতের ঘটনায় পুলিশ জড়িত। নিহতদের মধ্যে ৩০ জন থানা পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ এবং ডিবির ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয় সাতজন। এ সময়ে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ ২৪ জন এবং বিজিবির ‘ক্রসফায়ারে’ একজন নিহত হয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের নামে ক্রসফায়ারে কাউকে মেরে ফেলাও আরেকটি অপরাধ। তাই আমি বলব, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে বা জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে কাউকে গ্রেপ্তার করে আদালতে না পাঠিয়ে নিজে বিচার করা ঠিক নয়।’ আগস্ট থেকে ‘ক্রসফায়ার’ কমলেও নীতিগতভাবে বা নীতির দুর্বলতার কারণে এটা যে আর ঘটবে না, তা বলার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বন্দুকযুদ্ধ কখনোই ভালো পন্থা নয়। আর এটা যে ভালো নয়, দেরিতে হলেও সেই উপলব্ধি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হয়েছে। বলা চলে, এ কারণেও বন্দুকযুদ্ধ অনেকটা কমেছে।’
তবে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার স্পষ্ট বক্তব্য হলো, বন্দুকযুদ্ধ সব সময়ই একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে। র্যাব কখনোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে না। গত কয়েক মাসে মাদকসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে র্যাব। শুধু অভিযান চালাতে গিয়ে আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বন্দুকযুদ্ধের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে থাকে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগস্টের প্রথম দিকে সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হন। এর পরের দুই মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শূন্যে নেমে এসেছিল। যদিও পুলিশ-র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান আগের মতোই চলছে। এরপর সারা দেশে তিনটি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এ সময়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কয়েক লাখ ইয়াবার পাশাপাশি অস্ত্র উদ্ধার করেছেন। গ্রেপ্তার করেছেন অস্ত্রসহ শতাধিক সন্ত্রাসী।