সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন বছরে আসছে এক ছাতার নিচে

প্রকাশিত: ০৩:৫৮ এএম, ডিসেম্বর ৪, ২০২০

নতুন বছরে আসছে এক ছাতার নিচে

নতুন বছরের শুরুতেই এক ছাতার নিচে আসছে রাজধানীর খাল, বক্সকালভার্ট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা। মহানগরীকে জলজট এবং জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে এসব কাজ করবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঢাকা শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হয়েছে। এ সময় পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্বে থাকা সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসা একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করেছে। এতে নগরবাসী চরম ভোগান্তি মাড়ানোর পাশাপাশি আশাহত হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ওপর। জনদাবির মুখে দেরিতে হলেও এক ছাতার নিচে যাচ্ছে খাল, বক্সকালভার্ট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা। সমন্বয়হীন খাল, বক্সকালভার্ট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে দিতে। দীর্ঘদিন এসব নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সমাধান মিলেনি। তবে বিভক্ত ঢাকার দুই মেয়র সাঈদ খোকন এবং আনিসুল হকের সময়ে ভঙ্গুর খাল ও ড্রেনেজ নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে এ দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকে দিতে চাইলেও সেসময় দুই মেয়র এটা নিতে রাজি হননি। যদিও ওই সময় ঢাকা ওয়াসা খাল, বক্সকালভার্ট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছেড়ে দিতে রাজি ছিল। পরে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ দায়িত্ব নিতে রাজি হন। এরপর স্থানীয় সরকার বিভাগে এ ব্যাপারে সমঝোতার দায়িত্ব পালন শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ২৬ নভেম্বর খাল, ড্রেনেজ ও বক্সকালভার্টসহ ঢাকা ওয়াসার এ সার্কেল ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে ডিএনসিসি, ডিএসসিসি এবং ঢাকা ওয়াসার প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি চলতি মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি সভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে দুই সিটি কর্পোরেশনকে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জমান বলেন, ‘নতুন বছরের শুরুতেই ঢাকা ওয়াসা খাল, ড্রেনেজ এবং বক্সকালভার্ট দুই সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করা হবে। সে লক্ষ্যে কার্যকর প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ, খাল, বক্সকালভার্ট, অফিস এবং প্রয়োজনীয় জনবল (সিটি কর্পোরেশনের আগ্রহ সাপেক্ষে) হস্তান্তর করা হবে। আর যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেগুলোও ডিসেম্বর পর্যন্ত ওয়াসা করবে। জানুয়ারির শুরু থেকেই সিটি কর্পোরেশনের কাছে চলে যাবে। ডিএনসিসি অংশেরগুলো ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি অংশেরগুলো ডিএসসিসি পাবে এবং তারা এটা বাস্তবায়ন করবে।’ এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার জলজট, জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হলে খাল, ড্রেনেজ এবং বক্সকালভার্ট সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেটা এতদিন মেয়রের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে এখন এটার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন পেতে যাচ্ছে। সেটা হলে জলাবদ্ধতা নিরসনের সব বিষয় এক ছাতার নিচে আসবে। তাহলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। সেখানে ডিএনসিসির প্রতিনিধিও রয়েছেন। তারা কাজ করছে। আমরা দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পাশাপাশি দক্ষ জনবল, প্রকল্প, বাজেট, দখলদারদের তালিকাসহ সবকিছু বুঝে নেব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খালগুলোকে আমরা দখলমুক্ত এবং প্রবহমান করতে চাই। এজন্য যেখানে জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে তা করা হবে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা যে মাস্টারপ্ল্যান করেছে, সেটা নিয়ে সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’ এ বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খাল, ড্রেনেজ ও বক্সকালভার্ট সিটি কর্পোরেশনকে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে কারণে খাল সংস্কার, পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করা হচ্ছে। আমরা আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ডিএসসিসি এলাকার খালগুলো দখলমুক্ত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে চাই। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে নিজস্ব অর্থায়নে খাল উদ্ধার ও সংস্কার কার্যক্রম শুরু করব। ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নিচ্ছি। স্বল্প মেয়াদের কার্যক্রমগুলো আমরা নিজ অর্থায়নে শুরু করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, মূলত প্রথম কাজটি হল-যেগুলো দখলে আছে, সেগুলো মুক্ত করা। ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সিএস খতিয়ান) দেখে আমরা সীমানা নির্ধারণ করব। খালের মধ্যে যেসব বর্জ্য রয়েছে, তা অপসারণ করব। এর মাধ্যমে জলপ্রবাহ পুনরুদ্ধার করব এবং এর ফলে ঢাকার যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়ে থাকেব তা হবে না বলে আমরা আশাবাদী। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আগামী দু’বছরের মধ্যে ঢাকাবাসীকে আমরা জলাবদ্ধতা থেকে অনেকাংশে মুক্ত করতে পারব। এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘পেশাজীবীসহ বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশনকে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে জনবল, যন্ত্রপাতি, কারিগরি সক্ষমতাসহ সবকিছু দিতে হবে। এছাড়া এ সংক্রান্ত ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনকে খাল, ড্রেনেজ ও বক্সকালভার্ট সংস্কার এবং পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ উদ্যোগের ফলে ঢাকার জলজট এবং জলাবদ্ধতার সমাধান করা সহজ হবে। কেননা প্রথমত সিটি কর্পোরেশন সমন্বিত কাজের জন্য যোগ্য প্ল্যাটফরম। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরে নেতৃত্ব পরিচালিত সংস্থা এ কাজটি অত্যন্ত সুন্দরভাব সম্পন্ন করতে পারবে। দ্বিতীয়ত খাল ও ড্রেনেজ ভরাটের জন্য কঠিন ও তরল বর্জ্য অন্যতম দায়ী। যেটার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের হাতে। সে কারণে সিটি কর্পোরেশন এ দুটির মধ্যে সমন্বয় করতে পারবে। তৃতীয়ত খাল, ড্রেনেজ এবং বক্সকালভার্টগুলো কার্যকর রাখতে হলে জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজন রয়েছে। যেটা খুব সহজেই সিটি কর্পোরেশন করতে পারেব। কেননা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ের কাউন্সিলর এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে অফিস রয়েছে। যেটা মাঠপর্যায়ে জনম্পৃক্ততা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ’ এ বিষয়ে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, ‘ঢাকার খাল, ড্রেনেজ এবং বক্সকালভার্ট ব্যবস্থার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশনের কাছে নিয়ে আসা একধাপ অগ্রগতি বলা যায়। তবে শহরের টেকসই পানি নিষ্কাশন নকশা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা সিটি কর্পোরেশনেরও নেই। সে কারণে আমার মতে, শহরের ড্রেনেজ, খাল এবং বক্সকালভার্টের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের হাতে থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে। কেননা এসব কাজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকর সংস্থা।’ প্রসঙ্গত, ঢাকা শহরে শিরা-উপশিরার মতো অর্ধশত খাল ছিল। এসব খালের সঙ্গে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর সংযোগ ছিল। সেসময় এ শহরে কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খাল ভরাট করায় এখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার ড্রেনেজ তৈরি করলেও তাতে কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না।
Link copied!